লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে ৩৪টি স্কুল কাম আশ্রয়কেন্দ্র এবং সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দুই বছর মেয়াদের কাজ চার বছরেও শেষ করতে পারেনি নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘নাভানা কনস্ট্রাকশন’।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বহুমুখী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আশ্রয় প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ কাজের তদারকির দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)।
এদিকে সঠিক সময়ে নির্মাণকাজ শেষ না করার কারণে ওই সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জরাজীর্ণ স্থানে পাঠদান করানো হচ্ছে। এতে করোনাকালীন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং চরম দুর্ভোগের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া অরক্ষিত হয়ে আছে বিদালয়ের আসবাবপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। কবে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে তার কোনো সদুত্তর মেলেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
জেলা শিক্ষা অফিস বলছে, ভবন নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছে। আর এলজিইডি বলছে, গাফিলতির কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর লক্ষ্মীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ১৫৯ কোটি ৮৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ব্যয়ে মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার শেল্টার প্রজেক্ট (এমডিএসপি) এর আওতায় (প্যাকেজ নং-এলজিইডি/এমডিএসপি/এলএকে/১৪-১৫/এনডব্লিউ-০৬) লক্ষ্মীপুর জেলার ৩৪টি সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল ভবন নির্মাণকাজ পেয়েছে নাভানা কনস্ট্রাকশন নামীয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের আওতায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৭টি, রায়পুরে ৮টি, রামগঞ্জে ৩টি, রামগতিতে ১০টি ও কমলনগরে ৬টি সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল ভবন ও সংযোগ সড়ক, কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে সাব-ঠিকাদারের মাধ্যমে নির্মাণ শুরু করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২৪ মাস।
এলজিইডির হিসেব মতে, প্রকল্পের আওতায় গত প্রায় চার বছরে সদর উপজেলার পশ্চিম সৈয়দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ করা হয়েছে মাত্র ২৫ ভাগ।
রামগতির চরগাজি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ হয়েছে ২৭ ভাগ। একই উপজেলার চর পোড়াগাছা গুচ্ছগ্রাম ও মধ্য পূর্ব আলেকজান্ডার সরাকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ হয়েছে ৩৮ ভাগ। এভাবেই ওই অফিসের তথ্যবোর্ডে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ প্রকল্পের পৃথকভাবে ২৮-৬০ ভাগ এবং গড়ে ৪৮ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে।
সরেজমিন জেলার বেশ কয়েকটি প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত রড, সিমেন্ট, বালু, পাথরসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। স্কুল ভবনের কাজ, একতলার গ্রেটবীম, ছাদ, পিলারেই সীমাবদ্ধ। এতে স্কুল কমিটি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয়দের ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সদর উপজেলার মধ্য শাকচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় তিনতলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে ভবনের অনেক কাজ এখনো অসম্পন্ন রয়েছে।
২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নোমান। প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর হলেও সাড়ে তিন বছরে নির্মাণকাজ করা হয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। দীর্ঘ সময় থেকে ভবনের সামনে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী পড়ে বিনষ্ট হয়ে আছে।
প্রকল্পের নিরাপত্তাকর্মী আবদুর রব মিয়া জানান, তারা দুইজন পালা করে প্রকল্পের অবকাঠামো এবং নির্মাণসামগ্রী পাহারা দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত একজন প্রকৌশলীও আছেন। প্রায় ছয় মাস থেকে সেখানে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করা হচ্ছে না। ফলে সেখানে থাকা তিনশ ব্যাগ সিমেন্ট নষ্ট হয়ে গেছে।
ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এআরএম ইউসুফ বলেন, নির্মাণ কাজ শুরুর সময় আমরা পাশের একটি অস্থায়ী জায়গায় টিনের বেড়া দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করে শিক্ষার্থীদের সেখানে পাঠদান করাতাম। করোনার কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বিদ্যালয় বন্ধ থাকার পর আবারও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু অস্থায়ী এ বিদ্যালয়টির পরিবেশ ভালো না। বৃষ্টি হলে পানি ঢুকে স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়।
একই উপজেলার পূর্ব টুমচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি প্রায় পৌনে ১৪ লাখ টাকা। এলজিইডির হিসেবে মতে প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. কামরুদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, আমার আমলে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে কাজটি শুরু করা হয়েছে। আমি ছয় মাস আগে অবসর নিয়েছি। কিন্তু নতুন ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পারিনি। পাশের একটি অস্থায়ী ঘর দেখিয়ে তিনি বলেন, বহুকষ্টে শিক্ষার্থীরা এখানে ক্লাস করতেছে।
বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাবিহা আক্তার, মো. নাসিম হোসেন, ইয়াসিন আরাফাত বলে, অন্ধকারে এবং খুব গরমের মধ্যে ক্লাস করতেছি। আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।
প্রধান শিক্ষক ফেরদৌসী বলেন, জরাজীর্ণ কক্ষ হওয়ায় এখানে বিদ্যুতের সংযোগ নেওয়া হয়নি। তাই লাইট ফ্যান লাগানো হয়নি। কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছি।
শাকচর খাসমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ। দুই বছরের চুক্তি করে অন্যের জমিতে অস্থায়ীভাবে একটি স্কুল ঘর নির্মাণ করে পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। স্কুল ঘরটি একেবারে ব্যবহারের অনুপোযোগী।
প্রধান শিক্ষক আনোয়ারা বেগম জানান, বৃষ্টি হলে নিচ দিয়ে পানি ঢোকে। ভাঙা বেড়া, তাই স্কুলের আসবাবপত্র ও কাগজপত্র অরক্ষিত হয়ে আছে। করোনায় বন্ধ থাকাকালীন একটি ফ্যান ও শিশুদের খেলনা চুরি হয়ে যাওয়ার কথা জানান তিনি।
এ প্রকল্পের অধীন কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের চর পাগলা পাটওয়ারীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকায় ব্যয়ে ত্রিতল এ বিদ্যালয় ভবনটি ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল তারিখে নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন। কাজ উদ্বোধনের পর চার বছরে একটি ছাদও নির্মাণ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। প্রকল্পের ২৩ নম্বর সিরিয়ালের এ স্কুল ভবনটির কাজ ৪০ ভাগ শেষ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য বৃহস্পতিবার বিকেলে নাভানা কনস্ট্রাকশনের লক্ষ্মীপুরের অস্থায়ী অফিসে গেলে প্রকল্প ম্যানেজার মাহবুবুর রহমানকে পাওয়া যায়নি। তিনি ছুটিতে থাকায় প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা সজীব চন্দ্র দত্ত জানান, করোনার কারণে তাদের কাজ বন্ধ রয়েছে। আগামী অক্টোম্বর মাসের মধ্যে কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মঞ্জুর আলী চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নির্মাণাধীন ৩১টি বিদ্যালয়ের বিষয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী বরারব চিঠি লেখা হয়েছে। চিঠির অনুলিপি বিভিন্ন দফতরে দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা জানিয়ে ভবন নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের লক্ষ্মীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহ আলম পাটওয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নাভানা কনস্ট্রাকশন এক প্যাকেজে ৩৪টি স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারের নির্মাণকাজ করছে। তারা মন্ত্রণালয় থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি পেয়েছে। আমরা শুধু মনিটরিং এর দায়িত্বে আছি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাঝপথে কাজটি বন্ধ রাখায় প্রকল্পের চুক্তি বাতিল করার জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এপ্রিল মাসে লিখিত ভাবে জানিয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১
আরএ