লক্ষ্মীপুর: আড়াই একর জমিজুড়ে বসতবাড়ি, বাগান, পুকুর ও ফসলি খেত ছিলো আব্দুর রশিদের। গত ২০ বছরের ব্যবধানে সর্বনাশা মেঘনা তাকে ভূমিহীন বানিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকা লুধুয়াতে দেখা হয় ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ এ ব্যক্তির সঙ্গে। নদীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছি। ৩০ বছর আগে আমার বাড়ি ছিলো বর্তমান লুধুয়া বাজার থেকে ১০ কিলোমিটারের পশ্চিমে। ভাঙতে ভাঙতে সর্বশেষ এখানে (বর্তমান লুধুয়া বাজার) এসে ঠেকেছি। তিন মাস আগে এখানে থাকা বাড়িটিও সর্বনাশা মেঘনা কেড়ে নিয়েছে। এখন আর নিজে জমি কিনে বাড়ি করার সাধ্য নেই। তাই ভাড়া বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকি।
করুন এ ইতিহাস তুলে ধরার সময় চোখের কোনে পানিও চলে আসে আব্দুর রশিদের। কিন্তু রাক্ষুসে মেঘনার রাশি রাশি জলের কাছে আব্দুর রশিদের মতো হাজারো মানুষের চোখের জলের কোন মূল্য নেই। নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে গেছে তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বনটুকু।
ভাঙনের কবলে থাকা নদীর তীরের কয়েকটি বসতভিটা দেখিয়ে আব্দুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, এ যে বসতভিটাগুলো দেখতেছেন সেগুলো আমার ভাইদের ছিলো। তারা ঘর সরিয়ে নিয়েছে। হয়তো আজ কালের মধ্যে ভিটামাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
আব্দুর রশিদ যে বাড়িতে ছিলেন তার পূর্ব পাশে আরেকটি বাড়ি রয়েছে। বাড়িটির প্রায় ২০০ মিটারের মধ্যে চলে এসছে নদী। পাঁচ পরিবারের বসবাস ছিলো ওই বাড়িতে। এখন শুধু একটি ঘর দেখা গেছে সেখানে। ওই ঘরে আব্দুর রশিদের মেয়ে ফরিদা বেগম ও জামাতা আবু ছায়েদ তাদের সন্তানদের নিয়ে থাকতেন। সে বাড়িটি এখনো ভাঙেনি। আব্দুর রশিদের নাতি মিরাজকে দেখা গেছে একটি ট্রলিতে ঘরের মালামাল তুলতে। মিরাজের মা ও বাবা ঘর থেকে মালামাল বের করে দিচ্ছেন।
কোথায় যাবেন জানতে চাইলে মিরাজ বলেন, আপাতত একটি ভাড়া বাসা ঠিক করেছি। আগেও আরও তিনবার বসতবাড়ির স্থান পরিবর্তন করেছি। সর্বশেষ তিনমাস আগে আমাদের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। নানার দেওয়া জমিতে ছিলাম। এখন সেখানেও থাকতে পারবো না। আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে এ জায়গাটি নদী গর্ভে চলে যাবে। আমাদের বাড়িতে আরও চার পরিবারের ঘর ছিল। তারাও ঘর সরিয়ে নিয়েছেন।
মিরাজের বাবা আবু ছায়েদ বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর প্রবাসে ছিলাম। জমিজমা যা কিনেছি, সব এখন নদীতে। চা দোকান করে সংসার চালাই। আবার যে জমি কিনে ঘর করবো সে অবস্থা নেই। তাই ৫ ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে ফলকন ইউনিয়নের বোয়াইল্যা এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে উঠবো। লুধুয়া বাজারে যে চা দোকানটি আছে, সেটি হয়তো কয়েকদিনে মধ্যে নদী কেড়ে নিবে।
সরেজমিনে কমলনগরের চর ফলকন ও সাহেবের হাট ইউনিয়নের লুধুয়া এলাকায় দেখা যায়, নদী ভাঙা মানুষদের এমন করুণ চিত্র। প্রতিদিনই বাস্তুহারা হচ্ছে উপকূলীয় এলাকার শতশত বাসিন্দা। যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে, তারা নতুন করে ঘর বুনার স্বপন্ন দেখেছেন। যাদের যাওয়ার জায়গা নেই তারা উদ্বাস্তু হয়ে বসবাস করছেন।
লুধুয়া বাজার সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দূরত্বে নুর উদ্দিন বাগা বসত ঘর। দেড় বছর আগে নদী সংলগ্ন মূল বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর অস্থায়ীভাবে একটি ঘর করে থাকছেন তিনি। পরিবারে ৮ জন সদস্য রয়েছে তার। ঘরের সামনেই সর্বনাশী মেঘনা তাকে চোখ রাঙানি দিচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই কেড়ে নেবে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও।
কোথায় যাবেন, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিলোনা তার কাছে। তবে তুলে ধরলেন তার অতীতের স্বর্ণালী ইতিহাস। তার কথায়, এক সময় প্রচুর ভূমির মালিক ছিলেন তিনি। ১৫ একর সম্পত্তির ওপর ছিলো তার বসতবাড়ি। আর চরে ছিলো ২৫-৩০ একর ফসলি জমি। ৯০ দশকের পর থেকে ভাঙনের কবলে পড়ে আজ সর্বশান্ত তিনি।
লুধুয়া বাজারে উত্তর পাশেই জয়নাল আবেদীন মিঝি বাড়ি। ১২ পরিবারের প্রায় শতাধিক লোকের বসবাস ছিলো সেখানে। এখন মাত্র দুটি ঘর ছাড়া বাকি ঘর ভেঙে ফেলেছেন বাসিন্দারা। গাছপালাও কেটে ফেলছেন। কারণ নদী ফসলি জমি, পুকুর, বাগান নিয়ে গেছে। বাড়িটিও যেকোন সময় নিয়ে যাবে। বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা হয়তো আবার নতুন ঘর বাঁধবেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা ছিন্নমূল হিসেবে বসবাস করবেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য ইব্রাহিম খলিল বাংলানিউজকে বলেন, কি পরিমাণ মানুষ ভিটেহারা হয়েছে, তার কোনো নির্দিষ্ট হিসেব এখন আর নেই। তবে প্রতিদিনই গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৯৫ থেকে মেঘনা নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত চরফলকন ইউনিয়নের প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
চর ফলকন ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ বাগা বলেন, আমাদের বাড়িটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক জমিজমা ছিলো, তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন আজ নেই। বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প পাশ হয়েছে। আমরা বাঁধ নির্মাণের দিকেই তাকিয়ে আছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১
এনটি