কক্সবাজার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কোরান অবমামনার অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ পল্লিতে হামলার ঘটনা ঘটেছিল।
এসময় ১২টি বৌদ্ধবিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
পরদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরও চারটি বৌদ্ধবিহারে হামলা চালানো হয়। এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন।
এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। এ ঘটনার ৯ বছর পূর্ণ হলেও পুলিশ বাদী হয়ে করা ১৮টি মামলার একটিরও বিচার কাজ শেষ হয়নি। বর্তমানে সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে মামলাগুলো।
অন্যদিকে যার ফেসবুকে পবিত্র কোরান অবমানার অভিযোগ তুলে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছিল সেই উত্তম বড়ুয়ারও কোনো খোঁজ নেই অধ্যাবধি।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত ঘটনা ছিল রামু ট্র্যাজেডি। কিন্তু এ ধরনের একটি ঘটনায় হওয়া মামলাগুলো নয় বছরেও কোনো সুরাহা হয়নি। ভবিষ্যতে কিছু হবে কিনা বা এ ঘটনার কোনো ফলাফল আসবে কিনা তারা নিয়ে তারা সন্দিহান।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার নয় বছরে এলাকায় অনেক পরিবর্তনে এসেছে। সরকার ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন করেছে। সম্প্রীতির জায়গায় যে আস্থার সংকট সেটিও অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে।
কিন্তু মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় আছে সবার মাঝে। নয় বছর হয়ে গেছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে যাদের এসব মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে তাদেরও সাক্ষ্য দেওয়ার আগ্রহ নেই। সব মিলিয়ে আমরা যা দেখছি, এসব মামলাগুলোর ভবিষ্যত অন্ধকার। তাই ভয় একটাই, এতবড় একটা ধ্বংসযজ্ঞের বিচার না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে।
নাইক্ষ্যংছড়ি সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও রামুর বাসিন্দা নীলোৎপল বড়ুয়া বলেন, সেই সময় বৌদ্ধ সম্প্রদায় মামলা করতে রাজি না হওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলাগুলো করেছিল। কিন্তু এখন এই মামলা নিয়ে কোনো পক্ষের উৎসাহ নেই। সংশ্লিষ্ট সবার গা ছাড়া ভাব। ভুক্তভোগী, সরকার পক্ষ, বা মামলার সাক্ষী যার কথাই বলেন। ফলে মামলাগুলো ঝুলে আছে।
অন্যদিকে পুলিশ বাদী হওয়াতে মামলাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের লোকজনের অংশগ্রহণ খুব একটা ছিল না। তাই কাকে আসামি করা হয়েছে, কাকে সাক্ষী করা হয়েছে, কাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কাকে যুক্ত করা হয়েছে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে পুলিশ। সবচে বড় কথা হচ্ছে এই মামলাগুলো এখন অভিভাবকহীনের মতো হয়ে আছে। কারও কোনো চেষ্টা তদবির নেই। এ অবস্থায় আর বিচার চেয়ে লাভ কী।
জানা যায়, ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বররাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরও ছয়টি বৌদ্ধবিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরও চারটি বৌদ্ধবিহারে হামলা চালানো হয়। এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন।
এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে রামু থানায় আটটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুইটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরমধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ৩৭৫ জন। পরবর্তীকালে এসব মামলায় ৯৯৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এরমধ্যে রামুর আটটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৪৫৮ জনকে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের কোর্ট পরিদর্শক চন্দন কুমার চক্রবর্তী বাংলানিউজকে জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুপক্ষের আপস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। কিন্তু বর্তমানে মামলাগুলোর সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে বিচার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব মামলার সাক্ষী বেশির ভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা ঠিকমতো হাজির হচ্ছেন না। যে কয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন এরাও উল্টা-পাল্টা বলছেন।
এসব মামলার মধ্যে চারটি মামলা পুনরায় তদন্ত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কক্সবাজার। তারা ৩৬ জন নতুন আসামিকে চার্জশিটভুক্ত করেছে। বর্তমানে এসব মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ৯৩৬ জন।
এ মামলার তদন্তকাজে নিয়োজিত পিবিআইয়ের তৎকালীন এক কর্মকর্তা বলেন, এমনভাবে মামলাগুলোর অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, সাক্ষী পাওয়া না গেলেও আসামিরা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে এ রকম বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ রয়েছে, এসব দেখে শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালত চাইলে এদের শাস্তি দিতে পারে।
৯ বছরেও হদিস নেই উত্তম বড়ুয়ার-
এদিকে এ সাম্প্রদায়িক হামলার নয় বছরেও কোনো খোঁজ মেলেনি উত্তম বড়ুয়ার। মূলত বৌদ্ধ যুবক উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে কোরান অবমাননার অভিযোগ তুলে এই হামলার ঘটনা ঘটানো হয়। যে রাতে রামুতে হামলা হয় সেই রাত থেকেই উত্তমের আর খোঁজ নেই।
উত্তমের স্ত্রী রিতা বড়ুয়া বলেন, নয় বছর হয়ে গেছে এখনো কোনো খোঁজ পাচ্ছি না উত্তমের। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানিনা। ছেলেটি শুধু বাবা বাবা করে। বাবা কখন আসবে।
রিতা আরও বলেন, উত্তমের বাবার পরিবারও খুব অর্থকষ্টে আছে, সেদিক থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় একমাত্র ছেলেকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে আমাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১
এসবি/আরএ