ঢাকা, শনিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

নিয়ম মেনেই মোকিম-ঝড়ুর ফাঁসি, দাবি কারা কর্তৃপক্ষের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০২১
নিয়ম মেনেই মোকিম-ঝড়ুর ফাঁসি, দাবি কারা কর্তৃপক্ষের

যশোর:  চুয়াডাঙ্গার একটি হত্যা মামলায় ঝড়ু ও মকিম নামে দুই আসামির আপিল নিষ্পত্তির আগেই তাদের দণ্ড কার্যকরের খবরে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আপিল বিভাগে নিয়মিত আপিল করেছিলেন ওই দুই ব্যক্তি।

তবে আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয় তাদের। গণমাধ্যমে এমন খবরের তোলপাড়ের মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনেই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে ফাঁসি হওয়া মামলার নম্বরের সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া মামলার নম্বরের গরমিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত রবকুল মণ্ডলের মেজো ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেনকে ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন গ্রামের বাদল সর্দ্দারের বাড়িতে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কতিপয় চরমপন্থী কুপিয়ে হত্যা করে। ওইদিনই নিহতের ভাই মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়। রায়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির দুই আঞ্চলিক নেতা দুর্লভপুরের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আব্দুল মোকিম ও একই গ্রামের মৃত আকছেদ আলীর ছেলে ঝড়ুসহ ৩ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং দুর্লভপুরের মৃত কুদরত আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম ও একই গ্রামের আবু বক্করের ছেলে হিয়াসহ ২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি ১৬ আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

এদিকে মামলার রায় ঘোষণার পর উচ্চ আদালতে আপিল সূত্রে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এক আসামি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ২ আসামি আমিরুল ইসলাম ও হিয়ার সাজা মওকুফ করা হয়। তবে মোকিম ও ঝড়ুর ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে।

এরপর ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাত পৌঁনে ১২টায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়।

এদিকে, বুধবার ‘আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কারাগারে ২০১৭ সালে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে’- এমন একটি সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পুরাতন ফাইলপত্র নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ও জেলা প্রশাসনের।

চলে এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। পরে যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ, কারা-২ শাখার সহকারী সচিব মোহাম্মদ আলী ২০১৭ সারের ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত কারা মহাপরিদর্শককে লেখা চিঠিতে (নং-৫৮.০০.০০০০.০৮৫.২৭.০১৩.১৭.৬৭৪) যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারের চিঠির সূত্র উল্লেখ করে লেখেন : (১) মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত কয়েদী নং-৯০৭৫/এ, ঝড়–, পিতা-আকছেদ সরদার, (২) ত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত কয়েদী নং-৫৯৮/এ, মকিম, পিতা- মুরাদ আলী, উভয় সাং-দুর্লভপুর, থানা-আলমডাঙ্গা, জেলা-চুয়াডাঙ্গা এর প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক না-মঞ্জুর করা হয়েছে। এমতাবস্থায় জেল কোড অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এর আগে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর আপিল নিষ্পত্তি করে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বিচাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন এবং বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দার এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

যশোর কারাগারের বর্তমান জেলার তুহিন কান্তি খান বলেন, ‘এ ধরনের খবর শোনার পর আমি নিজে ফাইলপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। কোথাও কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি। আপিল বিভাগের রায় শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে সাধারণ ক্ষমা নামঞ্জুর হলে সরকারের পক্ষ থেকে আসামির ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কারও ফাঁসি কার্যকরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়া গেলে কারা অধিদফতর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষকে জানায়। এরপর কারাবিধি মেনে সব প্রক্রিয়া শেষে রশিতে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) মো. ছগির মিয়া জানান, ‘আপিল নিষ্পত্তির আগেই কারাগারে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে’ -এমন খবর তাদের নজরে এসেছে। কারা কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তবে এই বিষয়ে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান বলেন, তৎকালীন কর্মকর্তারা আইন মেনে ফাঁসি কার্যকর করেছে, দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির নথি যাচাই করে দেখা গেছে।  

অফিস নোটে যা লিখেছিলেন তৎকালীন জেল সুপার: ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. কামাল হোসেন একটি অফিস নোট তৈরি করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন: সংশ্লিষ্ট বন্দিদ্বয়ের মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় জানা যায় যে, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আবদুল মোকিম (৬০) ও মৃত আকছেদ আলীর ছেলে গোলাম রসুল ঝড়ু (৬২)। দুজনেই পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

১৯৯৪ সালের ২৮ জুন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে চরমপন্থী ক্যাডারদের হাতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন ইউপি সদস্য মনোয়ার হোসেন। তিনি স্থানীয় কুমারী ইউনিয়ন পরিষদে দুই মেয়াদে সদস্য ও কৃতী খেলোয়াড় ছিলেন। এ ঘটনায় তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। একই দিন আসামিদের গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে হাজির করেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারামতে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী রেকর্ড করে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া এবং সাক্ষ্য শেষে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২, ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল আসামি আবুল কালাম আজাদ, ঝড়ু ও মকিমকে ৩০২/৩৪/১১৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ডসহ এক লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশের সঙ্গে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ দেন। অন্যান্যদের মধ্যে আসামি আমিরুল ও হেলালকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো ৩ (তিন) মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ এবং বাকি আসামিদের বেকসুর খালাস দেন।

সংশ্লিষ্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই বন্দি সেই রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকায় আপিল করেন। আদালতের ডেথ রেফারেন্স নং- ৩৯/২০০৮, ক্রিমিনাল আপিল নং-২৫০০/২০০৮, ২৫০৪/২০০৮, ২৫৫১/২০০৮ এবং জেল আপিল নং- ৪২১-৪২৩/২০০৮ এর শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও পরের দিন প্রদত্ত রায়ে আসামি আবুল কালাম আজাদ ও আমিরুলকে বেকসুর খালাস দিলেও ঝড়ু ও মকিমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দি ঝড়ু ও মকিম ওই রায়ের বিরুদ্ধে পুনরায় সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন। আপিলের শুনানি শেষে আদালত ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর ঘোষিত রায়েও দুজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন।

এদিকে আপিল বিভাগ সংশ্লিষ্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দিদের ক্রিমিনাল আপিল ও জেল পিটিশন খারিজ হওয়ায় রায়প্রদানকারী চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-২ ওই দুইবন্দির জন্য পৃথক পৃথক মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরোয়ানা ইস্যু করেন। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবরে স্বাক্ষরিত কারা মহাপরিদর্শককে লেখা চিঠিতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারের চিঠির সূত্র উল্লেখ করে লেখেন: মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েদী নং-৯০৭৫/এ, ঝড়ু (২) মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েদী নং-৫৯৮/এ, মকিম প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতিক্ষর না-মঞ্জুর করা হয়। ২০১৭ সালের ভেম্বর যশোর কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয় তাদের। এর আগে,  ফাঁসির আসামি ঝড়ু ও মোকিমের পরিবারের সদস্যদের শেষ সাক্ষাৎ করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। ফাঁসির দিন দুপুরে ঝড়ুর পরিবার ও বিকেলে মোকিমের পরিবার শেষ সাক্ষাৎ করার জন্য কারাগারে প্রবেশ করেন।

কারাগারের নিরাপত্তার জন্য সন্ধ্যার পর থেকেই গোটা এলাকায় পুলিশ ও র‌্যাবের পাহারা বাড়ানো হয়। রাতে একে একে কারাগারে প্রবেশ করেন যশোরের জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, সিভিল সার্জন দিলীপ কুমার রায়, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুন-উজ-জামান। দুই আসামিকে গোসল করানোর পর তাদের তওবা পড়ান কারা মসজিদের ইমাম রমজান আলী। রাতে স্বজনদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পর খাবার খাওয়ানোর পর তাদের রায় পড়ে শোনানো হয়। এরপর তাদের জমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে একই কাষ্ঠে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ মশিয়ার ও লিটু। এর পর রাতেই তাদের মরাদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বাংলাদেশ সময় :  ১৬৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০২১
ইউজি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।