সিরাজগঞ্জ: ‘ছেলে আমার মস্ত বড় মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্লাটে যায় না দেখা এপার-ওপার’- বৃদ্ধাশ্রম শিরোনামে নচিকেতার এই জনপ্রিয় গানটি সত্যি প্রমাণিত হয়েছে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মোরশেদা খানম পিংকুলের জীবনে।
তার ছেলে সুহাদ হোসেন খান (৩৫) অফিসার না হলেও মস্ত বড় হাউজিংয়ের ইলেকট্রিক ঠিকাদার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যমুনা বিধৌত চৌহালী উপজেলার ঘোড়জান ইউনিয়নের চর জাজুরিয়া গ্রামের মৃত মুন্না খানের বাড়ির আঙিনায় পলিথিন দিয়ে তৈরি ঘরে বাস করেন মোরশেদা খানম। যমুনার কড়াল গ্রাসে নিজের বাড়িঘর হারিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এ বাড়িতে অবস্থান করছেন তিনি। চলতি মাসে শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় পলিথিন জড়ানো ঘরে তিনি চরম অসুস্থ হয়ে পড়লে এলাকাবাসী টাকা তুলে ৬টি টিন দিয়ে একটি ছাপড়া ঘর তুলে দেন। ঘরটির তিন দিকে বেড়া থাকলেও সামনের অংশে বেড়া ও দরজা নেই। ফলে সেখান দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে। তাই পলিথিন দিয়ে বাতাস ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বৃদ্ধার খাবার যোগাচ্ছেন অপর অসহায় বৃদ্ধা মৃত মুনা খানের অভাবী স্ত্রী লাইলী খানম। তার দিনমজুর ছেলের সংসারে ৫ সদস্য। নিজেদেরই ঠিকমতো দিন চলে না। অথচ এই অসহায় অন্ধ ও পঙ্গু বৃদ্ধা মোরশেদা খানমের দেখভাল তারাই করেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৌহালীর খান পরিবারের মেয়ে মোরশেদা খানম পিংকুলের বিয়ে হয় টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার মামুননগর ইউনিয়নের বলরামপুর গ্রামের আওলাদ হোসেনের সঙ্গে। যমুনা নদীর ভাঙনে বাড়িঘর জমিজমা বিলীন হয়ে গেলে চৌহালী উপজেলার ঘোরজান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চর জাজুরিয়া গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পরিবারসহ আশ্রয় নেন তারা। এরপর স্বামী ও বড় ছেলের মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েন। আনসার ভিডিপির চাকরি ও বিভিন্ন এনজিওর কাজ করে ছোট ছেলে সুহাদ হোসেন খানকে মানুষ করেন তিনি। সুহাদ হোসেন কিছু লেখাপড়া করার পর কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে হাউজিং কোম্পনিতে ইলেকট্রিক কাজ করতে থাকেন। একপর্যায়ে টাকা-পয়সা জমিয়ে নিজেই হাউজিং ইলেকট্রিক ঠিকাদারের কাজ করেন। তিনি বিয়ে করে বর্তমানে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ফ্ল্যাট বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু দীর্ঘ ৮ বছর ধরে মায়ের কোনো খোঁজ-খবর ও ভরণ-পোষণ করেন না সুহাদ। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো কাজ হয়নি। তিনি পরিচয় ও বাসার ঠিকানা দেন না বলে প্রতিবেশীরা জানান।
মোরশেদা খানমের আশ্রয়দাতা লাইলী খানম, প্রতিবেশী রেহানা বানু ও মাসুদ খান বলেন, স্বামী-সন্তানের শোকে কাঁদতে কাঁদতে তিনি অন্ধ ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে তার দুই পা পঙ্গু হয়ে গেছে। তিনি আর দাঁড়াতে পারেন না। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে তার দিন কাটে। তার সেবা যত্ন করার কেউ নেই। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি।
চৌহালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হযরত আলী মাস্টার বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছি। আমার সময়ে ঘোড়জান ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন মোরশেদা। ১৯৯২ সাল থেকে টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মতো একজন নারীর আজকের এ অবস্থা খুবই বেদনাদায়ক। একমাত্র ছেলে ফ্ল্যাটে বসবাস করলেও মা রয়েছেন জীর্ণ কুটিরে-এটা খুব কষ্টদায়ক ঘটনা। শুনেছি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে মায়ের খোঁজ-খবর নেয় না সে।
তিনি আরও বলেন, মোরশেদা দীর্ঘদিন উপজেলা আনসার ও ভিডিপির দলপতি হিসেবে অসহায় নারীদের জন্যে বিভিন্ন ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। এছাড়াও নারীদের জন্য বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ এবং দুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন তার জীবন জীবিকা চালে অন্যের দয়ায়।
চৌহালী আওয়ামী লীগের সভাপতি তাজ উদ্দিন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খুব শিগগিরই আমি খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা ইয়াসমিন বলেন, ওই বৃদ্ধার বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আপনার মাধ্যমেই জানতে পারলাম। শিগগিরই খোঁজ-খবর নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। তার সন্তানের বিরুদ্ধে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবো না। তবে তিনি ভরণ-পোষণ আইনে আদালতে মামলা করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২২
আরএ