ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘এলএ শাখার চুরিতে সবাই সমান ভাগ পায়’

মো. আমান উল্লাহ আকন্দ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২
‘এলএ শাখার চুরিতে সবাই সমান ভাগ পায়’

ময়মনসিংহ: দেশব্যাপী সরকারের উন্নয়নে ভূমি অধিগ্রহণের সম্পর্ক নিবিড় হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের শেষ নেই ময়মনসিংহের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়।  

অফিসের ছোট-বড় সবার সমন্বয়ে তৈরি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য।

গত মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় সদর উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত এক ভূমি মালিকের আত্মীয় পরিচয়ে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি ফাইল নিয়ে কথা বলতে গেলে কথা হয় সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীরের সঙ্গে।

এসময় তিনি বলেন, ‘আপনার ফাইলে ঝামেলা আছে। এটি মিসকেস করতে হবে। মিসকেসের জন্য ২২ হাজার টাকা লাগবে। এর মধ্যে ছয় হাজার টাকা অগ্রিম, বাকি টাকা কাজ শুরু হলে দিতে হবে। এরপর কাগজপত্র ঠিকঠাক হলে অধিগ্রহণের অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে নতুন করে আলোচনা করতে হবে। এজন্য প্রাপ্ত টাকার একটা অংশ আমাদের দিতে হবে। ’    

কথা বলার একপর্যায়ে পাশের টেবিলে এসে উপস্থিত হন আরেক সার্ভেয়ার মহিউদ্দিন আলম। তার সামনে কথা বলতে ইতস্ততঃ বোধ করায় সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর অধিগ্রহণ কাজে ঘুষ বাণিজ্যের দম্ভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এলএ (ভূমি অধিগ্রহণ) শাখার চুরির ভাগ সবাই সমান পায়। এখানে কোনো সমস্যা নেই। প্রত্যেকের স্বাক্ষর আছে। দুই টাকা কম আর বেশি কোনো সমস্যা নাই। আমি এটা খোলা কথা বললাম। প্যাচাপ্যাচি ঘষাঘষির কোনো কাম নাই। আগে যে কাজ করছে, তার কাছে জানেন, ওই ভাবে করেন। ডিটেলস বলার দরকার কী, এলএ শাখার সব কিছু বলার সুযোগ নাই। আপনি ভালো না মন্দ, কে জানে। ’  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নতুন সৃষ্ট ময়মনসিংহ বিভাগের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বেড়েছে উন্নয়ন কার্যক্রম। বর্তমানে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ৫৭টি প্রকল্প চলমান আছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পে অধিগ্রহণের আওতায় জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ চলছে।  

এসব প্রকল্পের অধীনে শত শত কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে এলএ অফিসের চেইনম্যান থেকে শুরু করে কানুনগো-সার্ভেয়ারসহ ছোট-বড় সব অসাধু কর্মকর্তার নজরও সেদিকে। আর এ কারণেই ভূমি অধিগ্রহণের বিপরীতে ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য ভূমির মালিকরা এলএ অফিসে আসতেই শুরু হয় ঘুষ বাণিজ্যের নানান ফন্দি।    

ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিমালিকদের অভিযোগ, এলএ অফিসে টাকা ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না। অধিগ্রহণের অর্থ পেতে ফাইল জমা দেওয়া থেকে শুরু করে চেক পাওয়া পর্যন্ত চুক্তির মাধ্যমে চলে টাকার খেলা। টাকা না পেলে নানা কারণ দাঁড় করিয়ে আটকে দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণের চেক।  

সদর উপজেলার এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তার পৈতৃক কিছু জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। ওই জমির ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় পেতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্ত অর্থের ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়েছে।

একই ধরনের অভিযোগ একই মৌজার আরও চারজন ভুক্তভোগীর। তারা জানান, সম্প্রতি এক কোটি টাকার চেক নিতে আট শতাংশ কমিশন দিতে হয়েছে।  

সদর উপজেলার শম্ভুগঞ্জ পুলিয়ামারী এলাকার রানা ও সাদ্দাম জানান, অধিগ্রহণের আওতায় আমাদের কিছু জমি রয়েছে। ওই জমির ক্ষতিপূরণের জন্য প্রতি লাখে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে কয়েকটি চেক পেয়েছি। তবে আরও কয়েকটি চেক ছাড়ানোর জন্য এক সার্ভেয়ারের সঙ্গে দর-কষাকষি চলছে। চেক ছাড়ানোর জন্য অগ্রিম টাকার পাশাপাশি যত টাকা ঘুষ ঠিক করা হয়, সে টাকার একটি চেক সার্ভেয়ারকে আগাম দিতে হচ্ছে। পরে অধিগ্রহণের টাকা ব্যাংকে জমা পড়লে তারা আগের দেওয়া চেকের মাধ্যমে ঘুষের টাকা উঠিয়ে নেবেন।

পরিচয় গোপন করে অফিসের এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারশ’ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমির মালিকদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ করে ঘুষ নিয়ে অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। তবে যাদের জমিতে সামান্যতম সমস্যা ছিল, তাদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের পরিমাণ ছিল আরও বেশি। আর এ কাজে অফিসের পাঁচজন সার্ভেয়ার মিলেমিশে কাজ করে সমানভাবে ঘুষের টাকা বন্টন করেন বলেও জানান তিনি।  

এসব অভিযোগের বিষয়ে ময়মনসিংহের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মাহমুদা হাসানের কাছে বিগত ৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে ‘ক’ ফরমে লিখিত আবেদন করা হলেও এখনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ আবেদনের ১৫ দিন পর বিগত ২০ জানুয়ারি ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সহকারী কমিশনার ইসমাত জাহান ইতু স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তিনদিন পর ওই সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হবে জানিয়ে চিঠি চালাচালি করেন। কিন্তু প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ওই সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়নি।  

ফোন কলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সমর কান্তি বসাক বলেন, ‘কতগুলো প্রকল্প চলমান আছে, তা দেখে বলতে হবে। তবে অভিযোগের বিষয়ে আপনি এলে সরাসরি কথা বলব। আমি এখন বাইরে আছি। ’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘অধিগ্রহণ বিষয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেবাপ্রার্থীরা কোনো ধরনের হয়রানির শিকার যেন না হন, সে ব্যাপারে অফিস সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে। অধিগ্রহণ কার্যালয়ের কেউ যদি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে অভিযোগ খতিয়ে দেখে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। ’    

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।