ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

উপকূলের জীবন-জীবিকা

দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে উপকূলের নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৭ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২২
দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে উপকূলের নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি

উপকূল ঘূরে এসে: আলেয়া বেগম, বয়স ৩০-এর কোটায়। অভাবের সংসারে মাছ ধরা থেকে শুরু করে ভারী কাজ করছেন।

কয়েক মাস আগে তার জরায়ু অপারেশন করা হয়। একই এলাকার রোকেয়া বেগমের ৬ মাস আগে জরায়ু অপারেশন হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তান স্থানীয় দাইয়ের দ্বারা ডেলিভারি করান পারভীন বেগম। তখন জরায়ু ব্যথা শুরু হলে ঠিক সময় চিকিৎসা না নিতে পারায় ইনফেকশন হয়। এক পর্যায় তা কেটে ফেলতে হয়। এমন চিত্র এখন প্রায় নারীদের। কেউ সাহস করে বলছে কেউ গোপন রেখে মরণব্যাধি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছেন।

ভোর রাত থেকেই দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারীরা সমান তালে কাজ করছে। সংসারের কাজ সামলিয়ে শীত আর গরম উপেক্ষা করে মাছ ধরা থেকে শুরু করে খেয়ে না খেয়ে পেটের দায়ে পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, হাশি, কাশি ও চর্ম জাতীয় রোগের মতো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এমন চিত্র দেখা যায় উপকূলীয় পাথরঘাটা উপজেলার একাধিক মৎস্য পল্লীতে। দারিদ্র্যের যাতাকলে নিষ্পেষিত নারী স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাদের দিকে কেউ খেয়াল রাখেনা। অসচেতনতা, অসাবধানতা এবং ভারী কাজের কারণেও জরায়ুসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর নদ ঘেষা পাথরঘাটা উপজেলায় শতভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। গভীর বঙ্গোপসাগরে কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়সের পুরুষরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করছে। আর বলেশ্বর ও বিষখালী নদীতে এখানকার নারীরাও সমানতালে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছে। সংসারের সকল কাজ সামলিয়ে মাছ ধরা ও শুটকি মাছ শুকানো উপকূলের নারীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। দারিদ্র্যের যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েও দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে।  

অধিকাংশ নারীর মতে, ভারী কাজ, সন্তান প্রসবকালীন গ্রাম্য দাইদের অদক্ষতা, মাসিকের সময় অসচেতনতার কারণে জরায়ু থেকে শুরু করে গাইনী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পাথরঘাটা নতুন বাজার, বিএফডিসি বাজার, রুহিতা, পদ্মা, লালদিয়ার চর, টেংরা, মাছেরখাল, হাজিরখালসহ একাধিক জায়গায় প্রতিদিনই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন নারীরা।

নদ-নদী থেকে আহরিত চিংড়ি, লইট্টা, পুঁটি, বাতাসী, চেলা, মলা, ঢেলা, টাকিসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরে এবং তা কুলে এনে বাছাইয়ের কাজ করছে এখানকার নারী। উপকূলের প্রান্তিক জনপদে দেখা যায় এমন হাজারো চিত্র। সকাল থেকে রাত অব্দি উপকূলের মৎস্য পল্লীতে শুঁটকি উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকেন নারী শ্রমিকরা। দারিদ্র্যতার কারণেই উপকূলের নারীরা এসব ঝুঁকির কাজে যেতে বাধ্য হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে পানির তীব্র সংকট দেখা দিলে দূর থেকে কলসিতে করে পানি আনাসহ নানা ভারী কাজ করে। নারীদের শরীরে অনেক চাপ পড়ে ফলে যথা সময় অর্থের অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না।

সরেজমিনে বলেশ্বর নদ পাড়ের রুহিতা গ্রামের শুটকি পল্লীতে কাজ করা নারী পারভীন বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সকাল থেইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাম করি। আবার রাইতে সংসারের কাম করি। শরীরে কিছুই থাহে না। রোগ-শোক মোগো জীবনের সঙ্গী। ডাক্তার দেহাইলেও কাম অয় না। ’ 

একই এলাকার আমেনা বলেন, শুটকির দুর্গন্ধে পেটে নানাবিধ ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি রোগে ভুগছি। অভাবের কারণে মাছ ধরাসহ ভারী কাজের করতে গিয়ে অনেক আগেই জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। বল্বেশর নদ পাড়ের খাদিজা, সুলতানা, মরিয়ম, ফিরোজা বেগমসহ অসংখ্য নারী ওই শুঁটকি পল্লীতে মাছ বাছাই শুকানোর কাজ করেন। তারা আরও জানান, দৈনিক ১০০-১৫০ টাকায় উপার্জন করে।

কথা হয়, দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বিএফডিসিতে কাজ করা ৫০ বছরের আলেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত ৪টা থেকে মাছ বাছা শুরু করি। শীতের সময় অনেক কষ্ট হয়। তারপরেও পেটের দায়ে কাজ করতেই হবে। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে কাজ করলে পা ফুলে যায়। এছাড়াও হাত ও পায়ের মাংস পেশিতেও অনেক সমস্যা হয়।

পাথরঘাটায় চারটি বেসরকারি কিনিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রায় শতাধিক নারীর জরায়ু অপারেশন হয়েছে। তাদের তথ্য মতে, এখানকার নারীরা ভারী কাজ, প্রসবকালীন গ্রাম্য দাইদের দ্বারা ডেলিভারি করানো এবং ডেলিভারির কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই ভারী কাজ শুরু করা। যার ফলে এটি বেশি হয়ে থাকে।

এ বিষয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) চর্ম রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বাংলানিউজকে বলেন, মাছ বাছাই ও শুটকি তৈরি কাজে পেটে ব্যথা, চর্ম জাতীয় নানা রোগ হয়। অনেকদিন ধরে এ অভ্যাসের কারণে হাতের চামড়া শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়। এর ফলে চুলকানির সৃষ্টি হয় এবং ত্বক মোটা হয়ে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ত্বকের রোগ অ্যাকজিমা সৃষ্টি হয়। এ দুর্গন্ধযুক্ত কাজে দীর্ঘস্থায়ী থাকলে ক্যান্সার এবং গ্যাংরি রোগের ঝুঁকি থাকে।

প্রতিকারের বিষয় তিনি বলেন, নিরাপত্তার জন্য হ্যান্ডগ্লাভস, মাথায় ক্যাপ এবং শরীরে সুতি সাদা কাপড় পরা উচিত। এছাড়াও কাজের ফাঁকে বারবার পানি ব্যবহার ও সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. লুৎফা বেগম লিপি বলেন, নারীদের এমনিতেই ভারী কাজ করা শরীরের জন্য ঝুঁকি। এর মধ্যে যদি হয় মাসিকের সময় তা তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে উপকূল অঞ্চল বা নিন্ম আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশই ঝুঁকির কাজ করে থাকেন। এর ফলে জরায়ুর সমস্যা বড় আকার ধারণ করে। তাছাড়া প্রজনন স্বাস্থ্য সুরাক্ষায় মাসিকের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ। উপকূল অঞ্চল বা নিন্ম আয়ের নারী এ সময়টা কাপড় ব্যবহার করে। তাছাড়া কড়া রোদে না শুকিয়ে ময়লা বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় শুকায়। এতে করে প্রজনন অঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে। এতে করে নারীদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়। তলপেটে ব্যথা, সাদাস্রাব, মাসিকের সময় অধিক রক্তপাত, বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে সহবাসে ব্যথা এমনকি স্থায়ীভাবে বন্ধ্যত্বও হতে পারে। অনেক সময় ইনফেকশন বেশি হলে ক্যান্সার ঝুঁকিও থাকে।

তিনি আরও বলেন, গ্রাম্য দাইদের দ্বারা নরমল ডেলিভারি করানো, ডেলিভারির পরপরই ভারী কাজ করা, পিরিয়ডকালীন শারীরিক সম্পর্কসহ নানা কারণে জরায়ুর সমস্যা হতে পারে। সঠিক সময় চিকিৎসা না নিলে এক পর্যায়ে জরায়ু অপারেশন করতে হয়। এ ক্ষেত্র দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।