ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অভিশাপ নয়, ভালোবাসায় জীবন বদলাতে চায় রত্নারা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২২
অভিশাপ নয়, ভালোবাসায় জীবন বদলাতে চায় রত্নারা

রাজশাহী: চৈত্রের খরতায় মলিন হতে চলছে বসন্তের পুষ্পাভ সৌন্দর্য। দিন যত গড়াচ্ছে সূর্যের প্রখরতা ততই বাড়ছে।

বাগানের ফুল গাছের পত্রপল্লবে সেই সবুজ সতেজতা যেন আর নেই। যেন হারাচ্ছে একটু একটু করে ফুলের সৌরভও।

কিন্তু এরপরও ফুলের সৌন্দর্য সব সময়ের জন্য স্বর্গীয়৷ তাই ফুল সব সময়ের জন্য নিজেই যেন একটি উপলক্ষ। তাইতো ফুল হাতে নিয়ে জীবন যুদ্ধে নেমেছেন রত্মা ও প্রিয়ারা। তারা জানেন পরিবেশ-পরিস্থিতি যা-ই হোক ফুল সব সময় ভালোবাসাই ছড়ায়। এজন্য ফুলের ভালোবাসা দিয়ে জীবন বদলাতে চান তারা।  

জোর করে বা হাত পেতে নয়, ফুল বেচেই ফিরতে চান অভিশপ্ত জীবন থেকে।

হ্যাঁ, রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে এখন নিয়মিত ফুল বিক্রেতা হচ্ছেন- রত্না ও প্রিয়া। অখণ্ড অবসর আর আনন্দ বিনোদন উদযাপনের সবাই ছুটে আসেন এই পদ্মাপাড়ে। কি নেই এই পদ্মা পাড়ে। মুখরোচক খাবার থেকে শুরু করে ফাস্ট ফুড। সবই আছে। নেই শুধু একগুচ্ছ মুগ্ধতা ছড়ানো ‌‘ফুল’। পদ্মা নদীর তীরে তাই এখন ফুল বিক্রি করছেন রত্না ও প্রিয়া। কথা বললেই যে কেউ নিশ্চিত হয়ে যাবেন, তারা কারা। রত্না ও প্রিয়া দুইজনই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। একটা সময় ছিল, যখন এই মানুষগুলোকে সবাই এড়িয়ে চলতেন। তারাও সাধারণ মানুষকে দিতেন নানান যন্ত্রণা।

হাতে তালি আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দিয়ে- বেড়াতে আসা মানুষকে কতবার যে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন তারা, সেসব ঘটনার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখনও মানুষের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা তুলতে দেখা যায় অনেক স্থানেই।
 
কেউ না কেউ ; কোনো না কোনোভাবে তাদের মাধ্যমে নাজেহাল হয়েছেন। কিন্তু কেনো তারা এই পথে? সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা। এরপরও পেটের দায়ে চাঁদা তুলে বেড়ানো অভিশপ্ত জীবন থেকে ফিরতে চান তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর এই মানুষগুলো।

রত্না ও প্রিয়া তাদেরই অগ্রজ। তারা এখন সেই পথ থেকে সরে এসেছেন। খুঁজে নিয়েছেন অর্থ উপার্জনের সৎ পথ। তারা নেমেছেন গ্রহণযোগ্য পথে জীবন-জীবীকা অর্জনে। এখন তারা নিজেরাই কাজ করে উপার্জন করছেন।

রাজশাহীর মহানগরীর বড়কুঠি এলাকার বাসিন্দা রত্না। আর কালু মিস্ত্রির মোড়ের বাসিন্দা প্রিয়া। রাজশাহীতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনার কাজ করছে রাজশাহীর দিনের আলো সংঘ।  

বর্তমানে এই দিনের আলোর সংঘের সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন প্রিয়া। আর রত্না হলেন সংগঠনেরই সদস্য। যিনি দীর্ঘ চার মাসের বেশি সময় ধরে মহানগরীতে ফুল বিক্রি করে আসছেন। তাকে দেখেই দুই মাস আগে প্রিয়াও এ পেশায় নেমে পড়েছেন। তাদের এমন কার্যক্রমে সাধারণ মানুষও বেশ উৎসাহ দিচ্ছেন। এতে কাজের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন তারা। যেখানে চাঁদা তুলে গুরু মায়ের হাতে তা তুলে দিয়ে নিরাপদে অন্যরা বাঁচতে চান সেখানে হঠাৎ করে এমন ভিন্ন কাজের প্রতি কেন এই আগ্রহ? সে বিষয়ে জানতে চাইলে রত্না কোনো রাখঢাক না করেই বলেন- চাঁদা তুললে তো মানুষ খুশি মনে টাকা দেয় না। উল্টো অভিশাপ দেয়।

তাদের সেই তাচ্ছিল্যের চাহনি আর অভিশাপে ভরা টাকা আমাদেরও সুখ দেয় না। চাঁদার টাকা অনেকে মুখের ওপরও ছুড়ে মারে। জোর করে টাকা নেওয়ার বদলে যারপরনাই অপমান সহ্য করতে আমাদেরকে। তাই এ জীবন আর ভালো লাগে না। এজন্য আমার মত অনেকেই এখন সমাজের সবার মধ্যে ফিরতে চান। নিজের শ্রম, মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে উপার্জন করে নিজের পেট চালাতে চান। লিঙ্গ পরিচয় পরে। আগে মানুষ হিসেবেই সমাজের আর ১০ জনের বাঁচতে চান তারা।  

এই কিছু দিনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে রত্না বলেন- হঠাৎ করে আমাদেরকে ফুল বিক্রি করতে দেখে মানুষ খুব খুশি হন। কেউ কেউ খুশি হয়ে ফুলের দামের চেয়ে বেশি টাকায় দেন। যেনো তারাও চান আমরাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরি। আমরা একেকজন রোজ ৭০-৮০টি গোলাপ বিক্রি করি। যে লাভ হয় তাতে আমরা ভালোই আছি।

তার অপর সাথী প্রিয়া বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, আরএমপি কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক ও জেলা প্রশাসক মো.আবদুল জলিল তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে অনেক আন্তরিক। তারা বিভিন্ন সময় তাদের যে বিভিন্ন কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন সহযোগিতার। এখন কাজ করি বলে আমি গর্ববোধ করছি। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন কাজ করে যেতে চাই। এরই মধ্যে রাজশাহী জেলা প্রশাসক তাদের তৃতীয় লিঙ্গের দুইজন সদস্যকে তার দপ্তরে চাকরি দিয়েছেন। অন্যরাও চাকরি দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তাই সবাই আশায় বুক বেঁধেছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কর্মের মাধ্যমে জীবন গড়তে চান জানিয়ে রাজশাহীর দিনের আলো সংঘের সভাপতি মিস মোহনা মঈন বলেন, তিনিও এই জনগোষ্ঠীর একজন। তিনি অনেক কষ্ট করে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ এই পর্যায়ে এসেছেন। অনেক সময় তাকে না খেয়েই দিন পার করতে হয়েছে। মানুষের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় কোথাও তারা দাঁড়াতে পারতেন না। অপমান আর ক্ষুধার যে কী কষ্ট! তিনি তা ভালো করে জানেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে অতীতের অবস্থা থেকে নিজেদের সবাইকে ফিরে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি।

মোহনা বলেন, কোভিড পরিস্থিতির কারণে তাদের এই জনগোষ্ঠীও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অন্যান্য জাতীগোষ্ঠির মানুষের মত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। কিছু সদস্য  যারা কর্ম করতেন তাদেরও কর্ম চলে গেছে। এ অবস্থায় তারা আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেকে বিভিন্নভাবে ঋণ নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চা নাচানো ও চাঁদাবাজি থেকে ফেরানোর নানান প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে মোহনা আরও বলেন, ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও এই জনগোষ্ঠীর জনগণকে কর্মমুখী ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমান সরকার যেমন তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেসঙ্গে পিতার সম্পদে অংশীদারিত্বও নিশ্চিত করেছেন। সরকারের এই পদক্ষেপকে তিনি স্বাগত জানান। অদূর ভবিষ্যতে সবাই হিজড়াগিরির এই আদি পেশা থেকে ফিরে আসবেন বলে স্বপ্ন দেখেন মোহনা।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।