ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ মে ২০২৪, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘মরি গেইলেও হামার খবর কায়ো নেয় না’

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৪ ঘণ্টা, মে ১, ২০২২
‘মরি গেইলেও হামার খবর কায়ো নেয় না’

লালমনিরহাট: ‌‘বাতাসের শো শো শব্দে উঠে দেখি ঘরটা বাতাসে দুলতেছে। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে বেটার (ছেলে) ঘরটা ভাঙ্গি পড়িল।

ঘরের সগায় কান্দি উঠলে বড় বেটা সহ দৌড়ে গিয়া বউ, বেটা আর নাতিকে টিন কেটে টেনে বাহিরে নিয়ে আসি। ’

শনিবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে খোলা আকাশের নিচে থাকা কালবৈশাখী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন মেহের বানু এভাবে ঝড়ের বর্ণনা করছিলেন।

এর আগে শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) দিনগত মধ্যরাতে লালমনিরহাটের ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিস্তাচরাঞ্চলের মানুষের। মেহের বানু আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের পাঠানটারী গ্রামের আবুল হোসেনের স্ত্রী।

মেহের বানু জানান, শুক্রবার রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন সবাই। মধ্যরাতে হঠাৎ ঝড় শুরু হয়। বাতাসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেন ঘর বাতাসে দোল খাচ্ছে। হঠাৎ পাশের ঘরে থাকা ছোট ছেলে আর তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর চিৎকার। বড় ছেলেকে ডেকে দৌড় দেন তিনি। ঘরে চাপা পড়ে আটকে আছেন ওই ঘরের তিনজন। টিন কেটে তাদেরকে উদ্ধার করেন। ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছেলের বউ মরিয়ম আঘাত পেয়ে অসুস্থ হয়েছেন। রাতটি অন্যের ঘরে কাটিয়ে সকালে তাদেরকে চিকিৎসার জন্য পাঠান হাসপাতালে।

শনিবার রিকশাচালক ছেলে রেয়াজুল ইসলাম অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে ভাঙ্গা ঘর পাহারা দিচ্ছেন বৃদ্ধা মা মেহের বানু। দিনভর অনেকের দুয়ারে গিয়েছেন ঘর মেরামতের বাঁশ সংগ্রহে। কিন্তু কোন সাড়া মেলেনি। ফলে খোলা আকাশের নিচেই পড়ে রয়েছেন তারা।

মেহের বানু বলেন, হামরা গরিব মানুষ। হুড়কা (ঝড়) বাতাসে মরে গেলেও কেউ খবর নেয় না। দিনভর খোলা আকাশের নিচে আছি। কেউ ভুলেও দেখতে আসেনি। ভোটের সময় সবাই আসে। বিপদের দিনে কেউ আসে না। একই গ্রামের আম্বিয়া বেওয়া স্বামী বিধবা মেয়ে রিনা বেগম ও তার সন্তানকে নিয়ে একমাত্র ঘরে বসবাস করেন। কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ঝিয়ের কাজ করে চলা বিধবা বৃদ্ধা আম্বিয়ার সেই ঘরে ছাউনি উড়ে যায়। মেরামতের টাকা নেই। পলিথিন সাঁটিয়ে রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

ওই গ্রামের মনির মিয়ার ছেলে আব্দুল হাকিম রিকশা নিয়ে বাহিরে ছিলেন। ঘর ভেঙে গেলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে সন্তানসহ নিজের জীবন বাঁচান স্ত্রী ফেন্সি বেগম। ঝড় থামলে বাড়ি ফিরে দেখেন জমি পড়ে আছে থাকার ঘর দুটি কালবৈশাখীর ছোবলে লণ্ডভণ্ড হয়েছে।

আব্দুল হাকিম বলেন, সারা জীবন কষ্ট করে ঘর দুটি বানিয়েছি। তা এক ঘণ্টার বাতাসে উড়ে গেছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, ডিসি ও ইউএনওসহ অনেকের কাছে গিয়েছি কোন সাহায্য পাইনি। সবাই আশ্বাস্ত করেছেন। কিন্তু রাতটা কীভাবে কাটাব?

এমন পরিনতি শুধু পাঠানটারী নয়। পুরো আদিতমারী উপজেলায় কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ক্ষতচিহ্ন। বিশেষ করে সারপুকুর, মহিষখোচা ও ভাদাই ইউনিয়নে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঈদের ছুটি ঘোষণা হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকাও তৈরি করেনি উপজেলা প্রশাসন।

ঝড়ে গাছ উপড়ে পড়ে শনিবার দুপুর পর্যন্ত অনেক সড়কের যোগাযোগ বন্ধ ছিল। লাইন ছিড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল দুপুর পর্যন্ত। গেল রাতের এ ঝড়ে উৎতি বোরো ধান, ভুট্টা আর সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মতিয়ার রহমান মতি বলেন, তিস্তা চরাঞ্চলের কোন বাড়ি ভালো নেই। প্রায় সব ঘরবাড়ি কালবৈশাখীর ছোবলে লণ্ডভণ্ড হয়েছে। ঝড়ে উড়ে গেছে মানুষের বসত ঘর। এখন পর্যন্ত দুই জনের দুইটি টিনের ঘর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জি আর সরোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, মহিষখোচা, সারপুকুর ও ভাদাই ইউনিয়নে বেশি ক্ষতি হয়েছে। চেয়ারম্যানদেরকে ক্ষতিগ্রস্তদের ছবিসহ তালিকা করতে বলা হয়েছে। বিকেলে মন্ত্রী মহোদয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন তিনজন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এসেছিলেন। তাদেরকে ঘর দেওয়ার কথা বলেছেন। তালিকা তৈরি করে তাদের পুনবাসন করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০০০২ ঘণ্টা, মে ০১, ২০২২
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।