ঢাকা, রবিবার, ২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ জুন ২০২৪, ০৮ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

আলোয় জেগে আছে দেশের প্রথম গুচ্ছগ্রাম আর তার মানুষগুলো

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০২২
আলোয় জেগে আছে দেশের প্রথম গুচ্ছগ্রাম আর তার মানুষগুলো এক সময়ের ঘরহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. একরাম উদ্দিন এখন নিজের ঘরে বসে পড়ালেখা করেন, আলো ছড়ান নিজের গ্রামে। ছবি: হোসাইন মোহাম্মদ সাগর

লক্ষ্মীপুর থেকে: ‘গল্পটা ১৯৭২ সালের প্রথম দিকের। মাইলের পর মাইল পুড়ে যাওয়া গ্রাম, জনবসতি।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে কয়েক সপ্তাহ আগে, কিন্তু তখনও অনেক জায়গায় পড়ে আছে মরদেহ। শকুন এসে খুবলে খাচ্ছে সেসব। ' তরুণ দৃষ্টিতে দেখা ৭১'র স্মৃতি থেকে এমন গল্প বলছিলেন ৭২ বছর বয়সী মাঈনুদ্দিন দুলাল।

স্মৃতি হাতড়ে যোগ করেন- 'এই অবস্থার সঙ্গে যোগ হয়েছিল মেঘনা নদীর ভাঙন। তলিয়ে গেছে ঘর বাড়ি। মাথা গোজার ঠাঁইও ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর কোমরে বুলেট রাখার বেল্ট বানাতাম। আর যুদ্ধের পরে টেইলার্সের কাজ করে কোনো রকমে বউ-বাচ্চা নিয়ে নানির বাড়িতে ছোট্ট এক ঘরের সংসার। সারাক্ষণ একটা ত্রাহি অবস্থা। একেতো পেট চলে না, তার ওপর দুর্ভিক্ষের আনাগোনা। সেই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসলেন নোয়াখালী, ঘর দিলেন আমাদের মতো অসংখ্য মানুষকে। প্রতিষ্ঠিত হলো দেশের ইতিহাসের প্রথম গুচ্ছগ্রাম। এই গ্রাম এখনও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আঁকড়ে জেগে আছে অসংখ্য মানুষের আশ্রয় হয়ে। '

মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) তৎকালীন নোয়াখালী (বর্তমান লক্ষীপুর) জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে কথা মাঈনুদ্দিন দুলালের সঙ্গে। চরপোড়াগাছায় সে সময় যে ২১০ জন মানুষের পুনর্বাসন করা হয়, তিনি তাদের মধ্যে একজন।

মাঈনুদ্দিন দুলালের স্ত্রী সামসুন্নাহার বেগম বাংলানিউজকে বলেন, 'এমনও দিন গেছে বাজান, ৩-৪ দিন ভাত না খাইয়া ছিলাম। কোনো দিন শুধু রুটি খাইতাম, কোনো দিন কচুপাতা সিদ্ধ কইরা খাইছি। এরপর যখন জায়গা পাইছি, তখন একটু শান্তি হইছে, দিন ফিরছে। '



মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চরপোড়াগাছায় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে গৃহহীন ও অসহায় পরিবারগুলোকে খাস জমিতে পুনর্বাসনের জন্য নির্দেশ দেন। যুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঘুর্ণিঝড়, নদীভাঙনসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত আশ্রয়হীন ২১০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয় সেখানে। সৃষ্টি হয় দেশের ইতিহাসে প্রথম গুচ্ছগ্রাম। সেই গ্রাম এখনও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আঁকড়ে জেগে আছে অসংখ্য মানুষের আশ্রয় হয়ে।

মো. শরিফ হোসেন নামের গুচ্ছগ্রামের আরও একজন বলেন, 'তখন যা অবস্থা, বঙ্গবন্ধু যদি আমাদের জায়গা না দিতেন, তবে হয়তো আজ আমাদের সন্তানরা রিকশা চালাতো অথবা খেতে-খামারে কাজ করতো। কিন্তু তা হয়নি, বঙ্গবন্ধু জমি দেওয়ায় আমাদের জীবনে পরিবর্তন এসেছে; আমার তিন ছেলে আজ গ্রাজুয়েট। '



গুচ্ছগ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার সবাই ২ দশমিক ৫ একর করে জায়গা পেয়েছেন। পুরো গ্রামে রয়েছে ২১টি পুকুর। আর প্রতি পুকুরকে পাড় ঘেঁষে ১০টি করে বাড়ি। সবুজ গ্রামটিতে পুরুষরা ছুটছেন দৈনন্দিন কাজে। নারীদের কেউ কেউ ব্যস্ত হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, মাছের খামার আর নিজ আঙিনায় গড়ে তোলা সবজির পরিচর্যা নিয়ে। ছোট্ট শিশুরা মেঠো পথ ধরে বই হাতে হেটে চলেছে স্কুলে।

গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা ও পল্লী চিকিৎসক মো. একরাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শুধু বসতবাড়ি নয়, চাষের জন্য জমি, পুকুর, লেখাপড়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জায়গাও দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের সন্তানরা এখন দেশের বিভিন্ন বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে, বিভিন্ন উচ্চ পদে চাকরি করছে, নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে সমাজে আলো ছড়াচ্ছে। আমরাও সেই চেষ্টায় করি। বঙ্গবন্ধুর সেই স্মৃতির আলোয় আলোকিত হয়েছি আমরা, সবাই মিলে আলোকিত করে জাগিয়ে রেখেছি বঙ্গবন্ধুর গুচ্ছগ্রামকে।

রামগতি উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খান বলেন, এখানে বসবাসকারীদের কেউ আর ভূমিহীন নয়। তাদের সবার এখন নিজস্ব পরিচয় আছে। আর তাদের আরও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগও রয়েছে সরকারের।

বাংলাদেশ সময়: ২২৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০২২
এইচএমএস/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।