ঢাকা : সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ শনিবার (২৬ জুন) পালিত হচ্ছে বিশ্ব মাদকমুক্ত দিবস। মাদকের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসটি সারাবিশ্ব জুড়েই পালিত হচ্ছে।
বিশ্বের দেশে দেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি।
দিবসটিকে সামনে রেখে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের উদ্বেগজনক একটি চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ, ১৩ ভাগ নারী। এক লাখেরও বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোররাও জড়িত মাদক ব্যবসার সঙ্গে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৬ লাখ বলে স্বীকার করা হয়েছে। আসক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ। অধিদপ্তরের জরিপে বলা হয়, আসক্তদের শতকরা ৯১ ভাগ কিশোর ও তরুণ। মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৫ ভাগ উচ্চশিক্ষা।
এদিকে ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পৃথক পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, দেশে সুই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকসেবির সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এ মাদকাসক্তরা শিরায় মাদক গ্রহণ কারায় এইচআইভি ঝুঁকির মধ্যে বেশি থাকে ।
আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি দেশি মুদ্রা পাচার হচ্ছে। কিন্তু ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য দেশে আসে। এরমধ্যে শুধু ফেন্সিডিলই আসে ২২০ কোটি টাকার। শতকরা ৬০ ভাগ মাদকাসক্ত মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর যে পরিমাণ অবৈধ মাদকদ্রব্য দেশে ঢুকছে তার মাত্র শতকরা ১০ ভাগ উদ্ধার সম্ভব হয়। র্যাবের তথ্য অনুযায়ী কেবল তাদের হাতেই ২০০৯ সালে ৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৪ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার হয়েছে। এ সময় ১৪ হাজার ২৫ বোতল বিদেশি মদ, ৩৫ হাজার ৭০৮ ক্যান বিয়ার, ২ হাজার ৮৪২ কেজি গাঁজা, ৪২ হাজার ২৮৪টি ইয়াবা, ৩৪.১৭৫ কেজি হেরোইন ও প্রায় ৫৮ হাজার নেশাজাতীয় ইনজেকশন উদ্ধার করা হয়েছে। এসময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫ হাজার ৫৯১ জনকে।
মূলত ভারত থেকেই আসছে মাদকের বড় বড় চালান। বিডিআর-এর একটি সূত্রে জানা যায়, বিস্তীর্ণ সীমান্তের ৫১২টি পয়েন্টকে মাদক আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করে চোরাচালানীরা। এসব পয়েন্টে বিডিআর এর বিশেষ নজরদারি থাকা সত্ত্বেও রাত-দিন আসছে হেরোইন, আফিম, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক।
মাদক সংক্রান্ত মামলার চিত্র
সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মাদক সংক্রান্ত মামলা ঝুলে আছে। র্যাব ও পুলিশের হাতে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। এরমধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে তদন্তাধীন মামলা রয়েছে প্রায় ৮ হাজার। মামলা হলেও সাী-প্রমানের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা।
রাজধানীতে মাদক ব্যবসার ‘বাজার’ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এমন ১১৬ জন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিভিন্ন থানা এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে এই তালিকা করা হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ের এসব ব্যবসায়ীদের গডফাদাররা এখনও পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকের নামই তালিকায় নেই। এসব তালিকা হালনাগাদ করতেও তেমন আগ্রহ প্রকাশ করে না আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।
৩২ ধরনের মাদক
দেশে বর্তমানে ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেড্রিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইএসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন।
এছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখা একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইদানিং মাদকাসক্তদের কাছে ফেন্সিডিল ও ইয়াবা ট্যাবলেটের কদর সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এত আটক এত গ্রেফতার-তবু যেন মাদকের প্রসার থামানো যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন র্যাব কর্মকর্তারা।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বেহালদশা
রাজধানীতে পাইকারী ও খুচরা মিলিয়ে ৫ শতাধিক মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে সহস্রাধিক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য ভাসমান বিক্রেতা। বিশাল এ সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন মাত্র ৫৯ জন। পাশাপাশি যাবাহনের সংখ্যাও অপ্রতুল। সাকুল্যে মাত্র ৩টি।
অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো-অঞ্চলের উপ-পরিচালক মজিবর রহমান পাটোয়ারী জানিয়েছেন, জনবল ও যানবাহনসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে অভিযান চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে অধিদপ্তরের কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অভিযান চালানোর জন্য ১৪টি সার্কেলে ১৪ জন পরিদর্শক থাকলেও তাদের সহযোগিতা করার প্রয়োজনীয় জনবল নেই।
১৪ সার্কেলের জন্য রয়েছেন ৭ জন উপ-পরিদর্শক, ৭ জন সহকারী উপ-পরিদর্শক এবং ৩১ জন সিপাই। অভিযান পরিচালনার জন্য রয়েছে জরাজীর্ণ ৩টি যানবাহন। এছাড়া অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে ১৪টি ওয়াকিটকি। মাদক ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম, দ্রুতগামী যানবাহন, ব্যাপক জনবল ও প্রভাবের সামনে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রীতিমত অসহায় বলেও মন্তব্য করেছেন উপ-পরিচালক মজিবর রহমান পাটোয়ারী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ইফসুফ আলী বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি কে বলেন, সীমিত জনবল আর নানাবিধ সমস্যা নিয়েও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মাদকের বিস্তার রোধে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলছেন। নিয়মিত চলছে মাদক বিরোধী অভিযান।
তিনি মাদকের প্রসার রোধে সামাজিক সচেতনতার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এক্ষেত্রে সেমিনার সিম্পোজিয়াম, র্যালি, আলোচনাসভাসহ মাদক বিরোধী নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক জানান, কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে এরইমধ্যে ৪ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
বাংলাদেশ সময় ১৩৫১ ঘণ্টা, ২৬ জুন ২০১০
এসআরআর/এএইচএস/এমএমকে