১৯৫০ সালে সংসদে পাস হওয়া হিন্দু উত্তরাধিকার আইন নারীদের সম্পত্তির অধিকার ও বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছে এবং বহুবিবাহ বেআইনি ঘোষণা করেছে। ১৯৭৬ সালে পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিয়ে আইনটি আরও কঠোর হয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যগত যৌথ পরিবার ভেঙে শহরে একক পরিবার গড়েছে এবং অনেক নারী কাজ বা তাদের নিজস্ব ব্যবসা করে যাচ্ছে। অনেক শহুরে নারী আর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য স্বামীদের ওপর নির্ভরশীল নন। অনেক পুরুষই সাংসারিক কাজের সহযোগী হচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে লিঙ্গ সমতা আসছে।
এখনকার ভারতের জনগণনা থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ সুরাজ ইয়াকুব ও নৃ-বিজ্ঞানী বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রীপর্ণা চট্টোপাধ্যায়। বিচ্ছেদের মধ্যেকার অর্ন্তদৃষ্টি নিয়ে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভবত এটাই প্রথম।
গবেষকরা বলছেন, ভারতের বিবাহ বিচ্ছেদের হার বিস্ময়করও নয়, আবার স্বাভাবিকও নয়।
গবেষণা বলছে, ভারতে ১৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ তালাকপ্রাপ্ত, যা বিবাহিত জনসংখ্যার ০ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং মোট জনসংখ্যার ০ দশমিক ১১ শতাংশ। আরো অদ্ভূত যে, বিচ্ছিন্ন থাকা মানুষের সংখ্যা তালাকপ্রাপ্ত মানুষের প্রায় তিনগুণ যা বিবাহিত জনসংখ্যার ০ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং মোট জনসংখ্যার ০ দশমিক ২৯ শতাংশ।
আরো অনেক নারী তালাক পেয়ে পুরুষদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যান।
ভারতে জনগণনার সময় নাগরিকদের চিরকুমার, আলাদা, তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা, বিবাহিত- এসব অবস্থা নির্বাচন করতে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু নারী কলঙ্কের ভয়ে আলাদা বা তালাকপ্রাপ্ত অবস্থার কথা জানাতে পারে না।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অন্যগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। সর্বোচ্চ বিবাহ বিচ্ছেদের হার মিজোরামে (৪ দশমিক ০৮ শতাংশ), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হারে থাকা নাগাল্যান্ডের (০ দশমিক ৮৮ শতাংশ) চার গুণেরও বেশি।
বড় বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে গুজরাটে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার সংখ্যা সর্বাধিক এক কোটির বেশি। আসাম, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ এবং জম্মু ও কাশ্মীর এর কাছাকাছি। মেঘালয়ে বিচ্ছিন্নতার হার বেশি এবং এর পরেই আছে মিজোরাম, সিকিম, কেরালা ও ছত্তিশগড়। এ পাঁচটি রাজ্যের তিনটিই উত্তর-পূর্ব ভারতের।
আজকের ভারতে বিবাহে ভাঙন বিষয়ক এসব পরিসংখ্যান নানা ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেমন, বেশি সংখ্যক মানুষ তালাকের চেয়ে আলাদা থাকছেন। কেননা, ভারতে তালাককে কলঙ্কের বলে মনে করা হয়। দেশটির বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার নিষ্পত্তিও হয় খুব ধীরগতিতে।
তালাকপ্রাপ্ত ও বিচ্ছিন্ন নারীদেরকে পুরুষরা আকর্ষণীয় বলে মনে করছে, যা ভারতের লিঙ্গ গোঁড়ামি এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রমাণ।
এর মানে হল যে, পুরুষের ধারণা, নারী হয় তালাকপ্রাপ্তা থাকতে পছন্দ করছেন অথবা পুনর্বিবাহের জন্য সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছেন না।
শ্রীপর্ণা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারতের নারীরা পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের মুখোমুখি হচ্ছেন। তাদের তালাক দেওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু পুনর্বিবাহ করা খুব কঠিন। কারণ, তালাকপ্রাপ্তাদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার শক্ত থাকে’।
গবেষকদের কাছে গবেষণার একটি ‘বড় বিস্ময়’ হিসেবে এসেছে যে- তালাক এবং বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে শহর ও গ্রামের মাঝে পার্থক্য খুব কম। ‘সুতরাং, শ্রেণী পার্থক্য থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। কিন্তু বাসস্থান একটি বিশাল পার্থক্য করতে পারে বলে মনে হচ্ছে না’- বলেন তারা।
রাজ্যের সঙ্গে অঞ্চলে তালাক ও বিচ্ছেদের হারে বিশাল তারতম্যও লক্ষ্যণীয়। যেখানে উপজাতীয় আইন কখনও কখনও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীদের বিয়ের আগে লিভ টুগেদারের অনুমতি দেয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিচ্ছেদের হার ভারতের অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। আবার উত্তর প্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা ও রাজস্থানের মতো উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে তালাক ও বিচ্ছেদের হার অনেক কম, যেগুলোতে গভীরভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত।
অন্যদিকে ৭১টি দেশের বিবাহ বিচ্ছেদের হার নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, বেলারুশে এ হার উচ্চমাত্রার, মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, যেখানে জর্জিয়ায় শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশেরও কম।
মজার ব্যাপার হলো, গুজরাটের বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেলারুশের চেয়ে অনেক বেশি আর জর্জিয়ার হার বিহারের কাছাকাছি।
‘যদিও বিবাহ বিচ্ছেদের হার এদেশে ‘আকাশচুম্বী, কিন্তু সার্বিকভাবে বিশ্বব্যাপী তালাকের হারের তুলনায় বেশি নয়। এর
অকল্পনীয় অনেক প্রমাণ আমাদের কাছে আছে’- বলেন ইয়াকুব ও শ্রীপর্ণা।
‘এছাড়াও বিয়ের আগে একত্রে বাসের হার (লিভ টুগেদার) ভারতে অত্যন্ত কম এবং বিবাহ সার্বজনীন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, কিছু তরুণ প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শেষ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৬
এএসআর/