উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন উপাদান থেকে যদিও অধিকাংশ জিন্স তৈরি করা হয়, আসলে জিন্সের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ ফরাসি শহর নিমস্। এখন একটি ছোট্ট কোম্পানি জিন্সের জন্মস্থানে নতুন করে জিন্স তৈরির কাজ শুরু করেছে।
নিমস্ শহরটি এক সময় বস্ত্রশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। ১৮ ও ১৯ শতকে শহরে বৃহৎ বৃহৎ কারখানা ছাড়াও অনেক বাড়িতে কাপড় উৎপাদিত হতো। হাজার হাজার লোক শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীতীরের তুলা, পশম ও রেশম ব্যবহার করে কাপড় তৈরি করতেন। এ কাপড় উত্তর আমেরিকার অনেক দেশে রফতানি হতো।
এ সমৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ১৮৬০ সালে ব্যবসায়ী লেভি স্ট্রস ডেনিম বা নীল জিন্স নামে পরিচিত নতুন ফেব্রিকটির আবিষ্কার করেন।
‘জিন্স’ নামকরণও করা হয়েছে ফরাসি শব্দ ‘সার্জ ডি নিমস্’ থেকে, যার অর্থ নিমস্ থেকে আহরিত একটি বলিষ্ঠ ফেব্রিক। আর এখন এ ফেব্রিকটিই জন্মস্থান ফ্রান্সের কোথাও উৎপাদন হয় না।
গাইলিয়াম সাগট নামক একজন তরুণ উদ্যোক্তা তার ছোট্ট কারখানার মাধ্যমে নিমস্ তথা ফ্রান্সের বস্ত্রশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্ন দেখছেন। নিমসের একটি সূর্যস্নাত আবাসিক রাস্তা প্রাঙ্গণে নিজের কারখানা খুলেছেন ৩১ বছর বয়সী এ উদ্যোক্তা।
সাগট দুই বছর আগে নিমসে কারখানার কাজ শুরু করেন। তার ধারণা ছিল, জিন্সের জন্মস্থানে জিন্স তৈরি সহজ হবে। কিন্তু বস্ত্রশিল্প শহরটির জন্য অতীত ঐতিহ্যে পরিণত হওয়ায় নতুন করে এ শিল্পের সূচনা করা তার পক্ষে কঠিন বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
‘আমি সামান্য আঁচড়ের দাগ থেকে এ শিল্পকে সম্পূর্ণ নতুন রূপে শুরু করতে চেয়েছিলাম’- বলেন তিনি।
এক জোড়া বিশাল কাঁচি দিয়ে একটি জিন্সের ক্যানভাস কাটেন সাগট। প্রথমে চকের সাহায্যে জিন্স খণ্ডের সীমারেখা আঁকেন তিনি। তারপর সাবধানে মাপমতো কেটে নেন। সবশেষে দেড় ঘণ্টার পথ দূরত্বের মার্সেইল শহরের একটি একটি ছোট্ট টেক্সটাইল কারখানার কারিগরদের কাছে জিন্স জোড়া লাগাতে পাঠান।
সাগট বলেন, ‘এ শহরে এখন একজন কারিগরও অবশিষ্ট নেই, যিনি জিন্স তৈরি করতে পারেন। আমি মার্সেইলে একজন দরজিকে পেয়েছি, যিনি আমাকে কাপড় কাটার শিক্ষা দেন। এখন আমি হাতের কাজটুকু শেষ করে মার্সেইলের কারখানায় জিন্স তৈরির জন্য পাঠাই’।
এমনকি সাগট সুদূর ইতালির ভেনিসের একটি পুরনো শাটল তাঁত কারখানা থেকে জিন্সের ক্যানভাস কিনে এনেছেন।
নিমস্ শহরের ইতিহাস জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর মার্টিন নৌগারেড জানান, ‘বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শহরটির বস্ত্র উৎপাদন কমতে থাকে। জিন্সের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ফ্যাশনের ধারা ও চাহিদা নিমস্ থেকে হারিয়ে যেতে থাকে’।
‘জিন্সের উৎপাদন প্রথমে ইউরোপ এবং তারপর এশিয়ার সস্তা শ্রম ও মূল্যের স্থানগুলোতে স্থানান্তর করা হয়। অবশেষে একসঙ্গে নিমস্ অঞ্চল থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায় এ শিল্প এবং শিল্পী ও তাদের দক্ষতা’।
সাগটের নিমসের বস্ত্রশিল্প পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নের বিষয়ে নৌগারেড বলেন, ‘হ্যাঁ, তার মতোই এ ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্মরণ বেদনা আমারও হয়। যদিও আমি সেটা সম্ভব মনে বলে মনে করি না। এখানে এটার চাহিদা আর নেই’।
‘বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্রশিল্প কারখানা সেসব স্থানে সরানো হয়েছে, যেখানে শ্রম সস্তা। ফ্রান্স এমনকি পশ্চিম ইউরোপের কারখানাগুলোর উচ্চ উৎপাদন ও শ্রম খরচের কারণে সেখানকার শিল্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না’- ব্যাখ্যা করেন মার্টিন নৌগারেড।
জিন্সের ৫০ শতাংশের বেশি এখন এশিয়ার চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে উৎপাদিত হয়। খরচ কমাতে সেখানকার নির্মাতারা কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার করায় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার কয়েকটি জিন্সের কারখানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
এশিয়ার অনেক নির্মাতা পলিয়েস্টারের সঙ্গে তুলা মিশ্রিত করেন। এর ফলে এসব কারখানার জিন্সের সেরা মানের কারণে চাহিদাও হু হু করে বাড়ছে, বিপরীতে অন্য স্থানের জিন্সের শিল্পের ইতি টেনে দিচ্ছে।
এতো চাপ সত্ত্বেও সাগট তার নিমসের কারখানায় জিন্সের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আশাবাদী।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৬
এএসআর/জেডএস