রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার হচ্ছে সভ্যতার সবচেয়ে স্থায়ী দানব, যা আমরা সৃষ্টি করেছি। এখন গবেষকরা বলছেন, এ মিথসৃষ্টিতে এমন কিছু রোগ ভূমিকা পালন করেছিল, যেগুলোতে জর্জরিত ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা।
কল্পিত চরিত্র ভ্যাম্পায়ার একজন মৃত্যুহীন মানুষ, যে প্রতি রাতে কবর থেকে উঠে এসে জীবিতদের গলা থেকে রক্তপান করে তৃপ্তি পায়। ফলে তার মরদেহে পচন ধরে না ও প্রতি রাতেই তার ভেতরে প্রাণ সঞ্চার হয়। আর যার রক্ত পান করা হয়, ধীরে ধীরে সেও ভ্যম্পায়ারে পরিণত হয়।
প্রাচীন গ্রিসেও রক্তচোষার এসব কল্পিত গল্প প্রচলিত ছিল। তবে অষ্টাদশ শতকে পূর্ব ইউরোপের ট্রানসেলভানিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে তা নিখুঁতভাবে তৈরি হয়ে পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহাদেশে এ মিথসম্প্রসারিত হয়ে আজ তা বিশ্বের অনেক সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে।
রোগ নির্ণয় ও উপসমে চিকিৎসা বিজ্ঞান তখন নিতান্তই অনুন্নত ছিল, যা ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য। আগাম সতর্কবার্তা ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ ও মহামারি, যে কারণে ব্যাপক মৃত্যু ও দুর্বিপাকনেমে আসে। আক্রান্ত পশুর কামড়ে অনেক মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, এটিও আসলে এক ধরনের রোগ। অথচ এরকম অবস্থাকে মানুষের ভ্যাম্পায়ারে কিংবা নেকড়ে বাঘে পরিণত হওয়ার গুজব ছড়ায়।
সভ্যতা থেকে অনেক দূরে থাকা এসব স্থানে পশুদের মাধ্যমে, খাদ্য বা পুষ্টির অভাবে এবং নিজেদের সুপ্ত জিন থেকেআরও কিছু রোগে আক্রান্ত মানুষকেও ভ্যাম্পায়ার বলে উপহাস করা হতো। পাহাড়ি অঞ্চলে আয়োডিন ঘাটতিতে ঘ্যাগরোগে ভোগাদেরও এ বিড়ম্বনায় পড়তে হতো।
গবেষকরা বলছেন, ‘ভ্যাম্পায়ার’ ধারণাটি বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণার ফলে সৃষ্ট। সেগুলো যে আসলেরোগ, তা তারা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম ছিলেন না। মরদেহে কিভাবে পচন ধরে সেটি নিয়েও পরিষ্কার ধারণা ছিল না। অনেক সময় সন্দেহের বশে কিছু কবর খোঁড়া হতো। মরদেহ পচে গেলে পেটের ভেতর থেকে এক ধরনের কালো তরল পদার্থ বের হয়। সাধারণ মানুষ সেটিকে তরল রক্ত বলে ভুল করতেন ও ধরে নিতেন যে, মৃতদেহটি ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলার অক্সফোর্ড পুনর্মূদ্রণের সম্পাদনাকারী লেখক রজার লাকহার্সট বলেন, ‘মানুষ এসব রোগের পেছনে অতিপ্রাকৃত ভ্যাম্পায়ারকে দায়ী করতে থাকেন। ফলে এ রোগগুলোই সভ্যতার সবচেয়ে স্থায়ী ও ব্যাপক প্রভাবশালী ভ্যাম্পায়ারের কাল্পনিক চরিত্র তৈরিতে সাহায্য করেছে’।
তিনি জানান, কিছু রোগাক্রান্ত মানুষও আবার কাল্পনিক ভ্যাম্পায়ারের মতো আচরণ করছিলেন। যেমন- পোরফিরিয়া রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের হিমোগ্লোবিনে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। মানুষ তখন ভেবে নেন, রোগের উপশম করতে রোগীর মাঝে রক্ত পান করার ইচ্ছে জাগে।
পোরফিরিয়ার আসল উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে, খুব কম সময়ের মাঝে সূর্যের আলোয় ত্বকে ফোস্কা পড়ে যাওয়া এবং রোগীর মূত্রে রক্তের উপস্থিতি, যা থেকে অন্যদের মাঝে সন্দেহ হতে পারে যে রোগী রক্ত পান করেছে।
আরো কয়েকটি রোগ ও উপসর্গ রয়েছে, যেগুলোও মানুষকে ভ্যাম্পায়ারের মতো আচরন করতে বাধ্য করে।
অ্যালিয়ামফোবিয়া হলে রোগী রসুনের কথা চিন্তা করলেই অস্থির হয়ে পড়েন। খাবারে রসুনের চিহ্ন দেখলেই দূরে পালিয়ে যান তারা। রসুনের কাছে এলে প্যানিক অ্যাটাকের শিকারও হয়ে থাকেন অনেকে।
ইসোপট্রোফোবিয়া বা ক্যাটোপট্রোফোবিয়া হলে মানুষ আয়নার সামনে আসতে ভয় পান। অ্যারিদমোম্যানিয়া হলে মানুষ তার আশেপাশে সবকিছু গুণতে ব্যস্ত থাকেন।
হাইপোহাইড্রোটিক অ্যাক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া নামের একটি দুর্লভ বংশগত রোগ আছে, যেটি হলে রোগীর দাঁতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। তাদের ক্যানাইন দাঁত বাদে অন্য দাঁতগুলো অনেক সময় একেবারেই গজায় না। আর গজালেও সেগুলোও হয় ক্যানাইনের মতো সূঁচালো।
জেরোডার্মা পিগমেন্টোসাম হলেও সূর্যের আলোয় বের হতে পারেন না রোগীরা। তাদের জিনের সূর্যের আলোর অতিবেগুনি রশ্মি সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। ফলে সূর্যের আলোয় গেলেই তার ত্বকে ফোস্কা পড়ে যায়। একদম কম আলোতে গেলেও তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি ঘরের ভেতরের আলোতেও মাঝে মাঝে তাদের সমস্যা হয়।
আলোর এ সংবেদনশীলতার প্রভাব এতো তীব্র হতে পারে যে, রোগীরা তাদের কান ও নাক হারান। তখন তাদেরএকটি চেহারাও কল্পিত রক্তচোষা বাদুরের মতো হয়ে যায়।
‘১৭৩০ সালে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ক্যাথলিক কৃষকদের মাঝে তৈরি হয় এসব রক্তচোষার গল্প। লন্ডন ও প্যারিসের বাসিন্দারা ইংরেজি সংবাদপত্রে জানতে পারেন। পরে পুরো ইউরোপজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করলে সভ্য ও অগ্রসর সমাজেও তা ছড়িয়ে পড়ে’- বলেন লাকহার্সট।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৬
এএসআর