ঢাকা: ১৯৮৯ সালে মার্কিন নৌ-বাহিনীর শত্রুর সাবমেরিন শনাক্তকারী যুদ্ধজাহাজ হাইড্রোফোন সসাসের নাবিকরা অদ্ভুত কিছু সংকেত শুনতে পান।
পরে আবিষ্কৃত হয়, সেগুলো তিমির গান ছিল।
এরপরও একা একা আলাদা ধরনের গান গেয়ে বেড়ানো ওই রহস্যময় তিমিকে প্রশান্ত মহাসাগরে দেখা গেছে বেশ কয়েক বছর ধরে।
এটি কি এখনও সেখানে আছে? এটি কি সত্যিই একা ছিল এবং কেন?- সেসব এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।
নীল তিমিটিকে বলা হচ্ছে ‘বিশ্বের নিঃসঙ্গতম তিমি’। কেননা, এটির গান অন্য কোনো তিমির মতো নয়। সে প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে একা একা চড়ে বেড়াতো, প্রলাপ বকতো, কখনো কখনো চিৎকার করে কাঁদতো।
নীল তিমিটি পুরুষ না মহিলা, কি প্রজাতির বা কার জন্য এভাবে কাঁদতো- তা কেউ জানেন না। এমনকি এখনও জীবিত আছে কি-না, সেটিও এটা জীবজগতের বড় রহস্য হয়ে আছে।
তবে ওই নীল তিমিটি আসলে এক ধরনের বিশেষ তিমি প্রজাতির সদস্য যাদের গান বা শব্দের কম্পনাঙ্ক ৫২ কিলোহার্টজ।
তিমিদের তিন প্রজাতি নীল তিমি, ডানা তিমি এবং কুঁজো তিমির করা শব্দের কম্পনাঙ্ক এর আগে ১০ থেকে ৪০ কিলোহার্টজের মধ্যে পাওয়া গেলেও এ প্রজাতির শব্দের মাত্রা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এ কারণেই এটি অন্যদের চেয়ে আলাদা।
এমনকি প্রজাতিটির নামও দেওয়া হয়েছে ‘৫২ কিলোহার্টজ তিমি’। অনেক বছর ৫২ কিলোহার্টজ তিমিদের গান শোনা গেলেও নাবিক বা সমুদ্র ভ্রমণকারীরা কেউ তাকে দেখতে পেতেন, কেউ পেতেন না।
কারণ, হুট করে সাগরের পানির ওপরে ভেসে বা লাফ দিয়েই টুপ করে আবার ডুবে যেতো তারা।
২০০৪ সালে এ প্রজাতির নীল তিমির গানের রেকর্ডিং তৈরি করা হয়েছিল, যার গানের কম্পনাঙ্কও ছিল ৫২ কিলোহার্টজ।
মার্কিন নৌ-বাহিনীর যে নাবিকরা প্রথমবারের মতো নতুন প্রজাতির নীল তিমির গান শোনার কথা বলেছিলেন, তাদের বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝতে পেরে এ রেকর্ড করেন বিল ওয়াটকিনস।
ম্যাসাচুসেটস উডস হোল ওস্যানোগ্রাফিক ইন্সটিটিউশনের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী গবেষক ওয়াটকিনসের জন্য ৫২ কিলোহার্টজ তিমি ট্র্যাকিং একটি আবেগময় ঘটনা হয়ে ওঠে।
২০০৪ সালে ৭৮ বছর বয়সে মারা যান ওয়াটকিনস্। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি তার ১২ বছর ধরে সংগৃহীত ৫২ কিলোহার্টজ নীল তিমির রেকর্ডিংগুলো প্রকাশ করেন।
ওয়াটকিনস ও তার সহকর্মীরা লিখেছেন, ‘এতো বেশি কম্পনাঙ্কের শব্দ অস্বাভাবিক হলেও সরাসরি অনন্য ছিল না। বছরব্যাপী ব্যাপক সতর্ক পর্যবেক্ষণ করে এ বৈশিষ্ট্যের শব্দ অন্য কোথাও পাওয়া গেছে। এবং প্রতিটির উৎস শুধুমাত্র এক ঋতুতেই হয়েছে।
‘হয়তো তার অস্বাভাবিক গান বিচ্ছিন্নও নয়। সম্ভবত তার সঙ্গীদের ভালোভাবে শোনাতে অথবা বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করতেই গানের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েছে। তবে এই অস্বাভাবিক নীল তিমি আমাদের তিমি এবং তাদের গান সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারে’।
এ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা না হলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, নীল তিমি কয়েক দশক ধরে তাদের শব্দ পরিবর্তন করেছে। তবে কেউ জানেন না, কেন তারা এটি করেছে।
তবে ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এটি শুধু প্রশান্ত মহাসাগরেই নয়, বিশ্বজুড়ে গভীর সমুদ্রগুলোতে ৫২ কিলোহার্টজ নীল তিমিদের গান শোনা গেছে।
১৯৬০ সালের পর থেকে নীল তিমিরা গানের শব্দের মাত্রা বাড়িয়েছে। যেমন, উত্তর আটলান্টিকের তিমিদের স্বরের কম্পনাঙ্ক ক্রমবর্ধমান হয়েছে।
হিলড্রেব্র্যান্ড ও তার সহকর্মী মার্ক ম্যাকডোনাল্ড ওই গবেষণায় এর কারণ সম্পর্কে এটাও অনুমান করেছেন যে, মানুষের শিকারে পরিণত না হতেই নীল তিমিরা তাদের স্বরকে ক্রমশঃ গভীর করছে।
এ ধরনের হুমকি প্রতিরোধে ৫২ কিলোহার্টজ কম্পনাঙ্কের শব্দ বা গান নীল তিমিদের মূল অস্ত্র বলেও মনে করেন তারা।
এদিকে গত বছর থেকে এ ধরনের নীল তিমি খুঁজে বের করে তার ওপরে তথ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র এবং গানের পূর্ণাঙ্গ রেকর্ডিং তৈরির লক্ষ্যে প্রশান্ত মহাসাগরে বিশাল বাজেটের অভিযান চলছে।
অভিযানকারীদের আশা, এটি বিশ্বের বৃহত্তম খড়ের গাঁদার মধ্যে একটি সুই খোঁজার মতো কাজ হলেও ৫২ কিলোহার্টজ তিমি পাওয়া এবং শ্যুট করা যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৬
এমএ/এএসআর/