৩৫০ মিলিয়ন বা ৩৫ কোটি বছর আগে গড়ে উঠেছিল যে সমুদ্র সৈকত, সেই ক্যাথেড্রাল আজ শুধু সৌন্দর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য বা প্রত্নতত্ত্বের অফুরান উৎসই নয়, অনেক মানুষের কাছে পবিত্রও।
পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল বা গির্জা সমুদ্র সৈকতে এমনকি প্রাচীন বিশাল ও শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন স্বর্ণের খনিও পাওয়া যেতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
ক্যাথেড্রাল উত্তর-পশ্চিম স্পেনের স্বায়ত্ত্বশাসিত গালিশিয়া অঞ্চলের ক্যান্টাব্রিয় সমুদ্রের সৈকত। ক্যাথেড্রাল বা গির্জা নামটিও দেওয়া হয়েছে এর গঠনশৈলীর ওপর ভিত্তি করে।
স্পেনের আদিবাসীদের উপকথায় বলা হয়েছে, ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগের মহাজাগতিক সংঘর্ষে লম্বা হয়ে ভেঙ্গে পড়ে প্রাচীন মহাদেশ লাউরুশিয়ার হিমালয়ের মতো পর্বতশ্রেণী গণ্ডোয়ানা। ক্যান্টাব্রিয় সমুদ্রের ওপর পড়ে সেটি তৈরি করে পাথুরে শিলার বিচ।
এদিকে সৈকতের উপরিভাগে হাজার হাজার বছর ধরে শিলা জমেছে, তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক গুহা ও পাথুরে স্থাপনা। বছরের পর বছর পানির আঘাতে এসব অন্ধকার গুহা ও স্থাপনাগুলোর দেয়ালে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, যা আর্কিটেকচার ভাষায় ক্যাথেড্রাল নামে পরিচিত। কারণ, সৈকতের ধারের পাথরগুলো দরজার মতো এমন আকারের গুহা গঠন করেছে, হঠাৎ দেখলে কোনো এক গির্জার ভেতরের অংশ বলে মনে হবে।
এ থেকেই সমুদ্র সৈকতটির নামকরণ করা হয়েছে ক্যাথেড্রাল বা গির্জা। সত্যিকারের নাম ‘পবিত্র পানির সৈকত’ হলেও ‘দ্য ক্যাথেড্রালস’ হিসেবেই এর পরিচিতি বেশি।
গালিশিয়া ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন রাজ্যগুলোর একটি এবং আ কোরুনিয়া, লুগো, ওউরেন্সে ও পোন্তেভেদ্রা প্রদেশ নিয়ে গঠিত। এর রাজধানী সান্তিয়াগো ডি কম্পোসটেলার সেন্ট জেমসের সমাধি ক্যাথিড্রাল অঞ্চলের দর্শকদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। লুগোর প্রদেশে পড়া সেন্ট জেমসের সমাধি বা ধর্মীয় স্থানটি তীর্থযাত্রীদের কাছে পবিত্র। গালিশিয়া অঞ্চলের উপকূল বরাবর সৈকতে সেন্ট জেমসের পদচিহ্ন ও নানা নির্দশন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় পবিত্র বলে স্বীকৃত ক্যাথেড্রালও।
গালিশিয় ক্যাথেড্রাল সৈকতের পানি প্রেইয়ার মতোই পবিত্র তীর্থযাত্রীদের কাছে।
গালিশিয়াকে সভ্যতার উচ্চশিখরে নিয়ে গেছেন রোমানরা। প্রায় ২ হাজার বছর আগে জয়ের পর রোমান সাম্রাজ্যে অন্তর্ভূক্ত হয় গালিশিয়া। সরকার নতুন স্বর্ণমুদ্রা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রচুর স্বর্ণ মজুদ করে রাখে ক্যাথেড্রাল সমুদ্র সৈকতে। এ স্বর্ণ রাখতে প্রাকৃতিক স্থাপনা ব্যবহার ছাড়াও নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি করে গড়া হয় কৃত্রিম স্বর্ণখনি। একইসঙ্গে সমুদ্র সৈকতসহ গালিশিয়া অঞ্চলজুড়ে নতুন নতুন স্থাপনাসহ সভ্যতার নানা অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়। সেসব অবকাঠামো আজও দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকটি স্থানীয় স্বর্ণখনিও আবিষ্কৃত হয়েছে।
খননকারীরা সৈকতের কাছাকাছি একটি রোমান সিরামিক, পণ্য পরিবহনের জন্য প্রাচীন রোমানদের ব্যবহৃত একটি বড় মাটির কলস বা ডলিয়ামের টুকরা এবং তা তৈরিতে ব্যবহৃত চুল্লি পেয়েছেন।
তাই গালিশিয়ার এই সমুদ্র সৈকতের পরতে পরতে রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য খুঁজে পেতে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ ও বিস্তৃত গবেষণা।
গালিশিয়ার পশ্চিম উপকূলের ফিনিশটেরি অন্তরীপ তীর্থযাত্রীদের অন্যতম গন্তব্যস্থল। যা রোমান যুগে পৃথিবীর শেষ উপদ্বীপ বলে বিবেচিত ছিল। এক মাইলের একটি প্রাগৈতিহাসিক পাথর বৃত্ত রয়েছে এখানে। এটি গড়বার উদ্দেশ্যকে একমাত্র ইংল্যান্ডের অজানা পাথরবৃত্তের সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছে।
সারা বছর এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। গত গ্রীষ্মে প্রায় আড়াই লাখ করে দর্শনার্থী প্রতিদিন ভ্রমণ করেছেন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘পবিত্র সপ্তাহ’ বলে পরিচিত স্পেনের একটি ছুটির দিনে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও ভ্রমণের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় ক্যাথেড্রাল বিচ।
ভাটার সময় দর্শনার্থীরা সৈকতের পাথুরে শিলা দরজার তলদেশ, গুহার ভেতরে, উপকূল বরাবর পায়ে হেঁটেই ভ্রমণ করতে পারেন। আর জোয়ারের সময় স্থলভাগ নোনা জলে ভরে গিয়ে সেগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। এ সময় চিত্তাকর্ষক শিলা গঠনের সারাংশ দেখা যায়।
গালিশিও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ গ্রুপ মেরিনা প্যাট্রিমোনিও’র সভাপতি ম্যানুয়েল মিরান্ডা বলেন, ‘জোয়ার-ভাটার সময়ের মধ্যে সৈকতের ইতিহাসের হারানো ট্রেস ফিরতে থাকে। এলাকার সর্বশেষ রহস্য স্পষ্ট হয় এবং সমুদ্র আবদ্ধ অতীতের অবশেষগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৬
এএসআর/টিআই