১৮৮১ সালে জেনারেল চার্লস গর্ডন (পরে খার্তুমের গর্ডন নামে পরিচিত) যুক্তরাজ্য থেকে পূর্ব আফ্রিকার সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত দীর্ঘ ভ্রমণ করেন। সিসিলি ভারত মহাসাগরের ১১৫টি দ্বীপের সমষ্টি, যেগুলোর অধিকাংশই মানুষের বসতিহীন।
গর্ডন ছিলেন একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্রিস্টান মহা বিশ্বতত্ত্ববিদ। তিনি সিসিলি উপত্যকাকে এদন বা স্বর্গীয় উদ্যান বলে উল্লেখ করেন, যার বিবরণ বাইবেলের আদিপুস্তকে আছে।
গর্ডনের ভাষ্য ছিল, ‘আদম-হাওয়ার মিলনস্থল এদন উদ্যানের মতোই সিসিলিতে ‘নাট কোকো ডি মার’ প্রজাতির গাছ প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। এ গাছকে অলৌকিক ও স্বর্গের বলে উল্লেখ করা হয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনীতে। তাই এটিই সেই এদন উদ্যান’।
‘নাট কোকো ডি মার’ বাদাম ও নারিকেলের সমন্বিত একটি পাম গাছ, যা খেজুর গাছের একটি বিরল প্রজাতি, যা শুধুমাত্র সিসিলি দ্বীপপুঞ্জেই দেখা যায়। এ গাছটিকেই আদম-হাওয়া থেকে নর ও নারীর জন্মের সেই ঘটনাস্থল বলে মনে করেন গর্ডন।
সিসিলির প্রেসলিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনাঞ্চল ভ্যালে ডি মাই বিশ্বের ক্ষুদ্রতম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের একটি। গর্ডনের ভ্রমণের ১৩৫ বছর পরেও সেখানকার প্রবেশমুখেই এ গাছের প্রাচুর্য রয়েছে। ১০ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ ও ৪ মিটার প্রস্থের বিরাট বিরাট খেজুর প্রজাতির গাছের ঘন বন তৈরি হয়েছে সেখানে। এর চওড়া পাতা আশেপাশের গাছগুলোর শাখার সঙ্গে মিলে ৩৪ মিটার পর্যন্ত পুরু শামিয়ানা গঠন করে যেন আকাশকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ফলে তীব্র শ্যামলিমাময় প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সেখানে।
সেখানকার মাটির পথ উচ্ছ্বাসিত উদ্ভিদের আড়ালে ঢাকা এবং মানব জীবনযাপনের কোনো লক্ষণ নেই। শুধুমাত্র প্রাচীন খেজুরের একটি জঙ্গল সেটি, স্বতন্ত্র অর্থে যা বিশ্বের অন্য কোনো জায়গা থেকে আলাদা। বড়, সাহসী, ঘন এ ভ্যালে ডি মাই বন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই অক্ষত রয়েছে। সেখানে মানুষের কোনো বসবাস ছিল না।
তবে প্রেসলিনের মেইনল্যান্ডে মানুষের বসবাস রয়েছে। দ্বীপটি সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের ১২টি জনঅধ্যুষিত দ্বীপের একটি।
শুধুমাত্র নান্দনিক প্রাচুর্যের কারণেই গর্ডন একে এদন উদ্যান বলেননি। তার মতে, ‘ভ্যালে ডি মাই এর ‘নাট কোকো ডি মার’ গাছেও নর ও নারীর জন্মের একটি বিশেষ রহস্যময় বিরল ইঙ্গিত রয়েছে। খেঁজুর প্রজাতির গাছটির বীজ দেখতে পুরুষ ও নারীর মিলনসহ মানব প্রজননের প্রক্রিয়ার চিত্রায়ন। মানব শরীরের পরিচিত অংশের একটি ভুতুড়ে প্রতিচ্ছায়াও বহন করছে। উদ্ভিদ জগতের বৃহত্তম ও গুরুসম এসব বীজ প্রাপ্তবয়স্ক আকারে এমনকি ৩০ কেজি পর্যন্ত ওজনেরও হয়।
সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের অনেক কিছুই রহস্যময়। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর সাদা-বালি সিসিলিজুড়ে সর্বত্র পাওয়া যায়। অত্যুচ্চ পাথরে সুরক্ষিত কিছু বৃত্তাকার সৈকত রয়েছে এখানে। অন্যান্য দ্বীপের মতোই প্রেসলিনেরও রয়েছে গ্রানাইট ভূমি। তবে ছোট্ট ভ্যালে ডি মাই এদন উদ্যান হিসেবে পরিচিত হয়ে একে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। বাকি বিশ্বের অবশ্য এটা মনে রাখা কঠিন যে, প্রাচীন পৃথিবী এই মাত্র কয়েক কিলোমিটারে বিদ্যমান ছিল।
তবে শত শত বছর ধরে এদন উদ্যানের মূল অবস্থান নিয়ে বিতর্ক করে আসছেন পণ্ডিতরা। তবে ভ্যালে ডি মাই এর পথ দিয়ে হেঁটে এবং এর অবিশ্বাস্য জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তবসম্মত প্রকৃতি ও বিরল বৈশিষ্ট্য দেখে অনেকের মধ্যে সামান্য সন্দেহ নেই যে, সেটি পৃথিবীর এই অংশেই ছিল এবং তা থাকাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৬
এএসআর/টিআই