বিশাল আকৃতির বীজগুলো শত বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্গত আরব উপদ্বীপের তীরে যখন ভেসে এসেছিল, তখন তারা দ্রুত একটি পৌরাণিক আবেগ তৈরি করে ফেলে। সেগুলোকে উর্বরতার প্রতীক ও উপহার হিসেবে দেখতে শুরু করেন সেখানকার বাসিন্দারা।
এটা ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে, বৃহৎ ‘নারকেল’ বীজগুলো সমুদ্রতলদেশীয় খেঁজুর গাছের সঙ্গে দূরে ভেসে এসেছিল। এবং বিশ্বাসঘাতক মানুষেরা সেগুলোকে সমুদ্রে ফেলে দেন। মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা এই বিরল কোষাগারের জন্য নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেন। সেসব ডুবো খেঁজুর গাছ অনুসন্ধানে বিভ্রান্তভাবে প্রচেষ্টাও চলতে থাকে।
পরে জানা যায়, সেগুলো ‘নাট কোকো ডি মার’ প্রজাতির গাছের বীজ, যা ৩০ কেজি পর্যন্ত ওজনেরও হয়। নাট কোকো ডি মার মূলত একাধারে বাদাম ও নারিকেলের সমন্বিত একটি পাম গাছ, যা খেজুর গাছেরও একটি বিরল প্রজাতি।
গাছটির বীজে নর ও নারীর জন্মের একটি বিশেষ রহস্যময় বিরল ইঙ্গিত থাকার কারণেই শক্তিশালী কামোদ্দীপক গুণাবলী সম্পন্ন বলে মনে করা হয়েছিল। বীজটি দেখতে পুরুষ ও নারীর মিলনসহ মানব প্রজননের প্রক্রিয়ার চিত্রায়ন।
বিশেষত ঝড়ো রাতে পুরুষ ও নারীর কামোত্তজনা সম্বলিত মিলনের অংশ গাছটি ও বীজে বিজড়িত হয়। মানবজন্ম ও বৃদ্ধিরও নিদর্শন সেটি। মানব শরীরের পরিচিত অংশের একটি ভুতুড়ে প্রতিচ্ছায়াও বহন করে এটি। ক্রমবর্ধমান বড় ‘পুরুষ’ বীজটিকে বাহন এবং নারী বীজটিকে বাহক কল্পনা করে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিতও করা হয় এ বীজকে।
মজার ব্যাপার হলো, ১০ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ ও ৪ মিটার প্রস্থের সংবেদনশীল গাছটি ভারত মহাসাগরের সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের শুধুমাত্র প্রেসলিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনাঞ্চল ‘ভ্যালে ডি মাই’ তেই জন্মে। এ বন বিশ্বের ক্ষুদ্রতম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের একটি।
মধ্যপ্রাচ্যে এ গাছ উৎপাদনের অসংখ্য চেষ্টা হলেও কোনোটি সফল হয়নি। একটি বীজ অঙ্কুরিত হতে তিনমাস সময় লাগে এবং অতি অবশ্যই মানুষের অস্পৃষ্ট থাকতে হবে, যে পরিবেশ কেবলমাত্র ‘ভ্যালে ডি মাই’ তেই আছে।
তবে এর কিংবদন্তি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে, যা ছিল সত্যের সঙ্গে অনেক কল্পনার সংমিশ্রণ।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় যে, ‘ভ্যালে ডি মাই’ কে কয়েক শতাব্দীজুড়ে সেই এদন উদ্যান বলে মনে করা হচ্ছে, পৌরাণিক কাহিনীমতে যেখান থেকেই নর ও নারী জীবনের সূত্রপাত। আদম-হাওয়ার মিলনস্থল স্বর্গীয় এ উদ্যানের উল্লেখ ও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে বাইবেলের আদিপুস্তকেও। এর বৃক্ষ আচ্ছাদিত ঘন বনপথ, অবিশ্বাস্য জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তবসম্মত প্রকৃতি ও বিরল বৈশিষ্ট্যও এদনের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়।
আবার ‘নাট কোকো ডি মার’ গাছটি ও এর বীজের গঠনশৈলি দেখে আদম-হাওয়ার সঙ্গম ও তা থেকে নর ও নারীর জন্মের সেই ঘটনাস্থল বলে মনে করেন অসংখ্য মানুষ।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে সিসিলি সুসম্পন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারালেও ‘এদন গার্ডেন’ রক্ষায় অনেক কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
‘নাট কোকো ডি মার’ সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের প্রতীক। ‘ভ্যালে ডি মাই’ পার্কটিকে তাই সংরক্ষকরা ভীষণভাবে সুরক্ষিত রেখেছেন, সদম্ভে এটিকে দেখাশোনা করছেন। ‘নাট কোকো ডি মার’ গাছটির বীজও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। পর্যটক ও স্থানীয়দের বীজ কিনতে একটি পারমিটের প্রয়োজন হয় এবং শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সংরক্ষককে পার্ক এলাকা থেকে একটি সীমিত সংখ্যক সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়। অন্য কেউ তা ধরলে পাঁচ বছরের কারাবাসের সম্মুখীন হবেন।
সিসিলি উপত্যকাজুড়ে রহস্যময় আরও বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। সেখানে ভুতুড়ে দৃষ্টিশক্তি ও ক্ষমতা সম্পন্ন ছোট ছোট অসংখ্য প্রাণী বাস করে। গেকো, বড় আকারের স্লাগ, গাছ ব্যাঙ, গিরগিটি, পতঙ্গ এবং অবশ্যই এদনের বিখ্যাত সাপ গার্ডেনে ভরপুর দ্বীপপুঞ্জটি। বিখ্যাত ও অত্যন্ত বিপন্ন বন্য কালো তোতাপাখিও রয়েছে, যা ‘নাট কোকো ডি মার’ গাছে তার নীড় তৈরি করে। এ পাখি এ ও ‘নাট কোকো ডি মার’ উর্ধ্বতন জীবনে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তোতা গাছের পরাগ বয়ে নিয়ে পরাগায়ন করে আর গাছটিতে কেবল তোতারই নীড় হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৬
এএসআর/টিআই