ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান, সূউচ্চ মন্দিরসম টাওয়ার জিগ্গুরাটস্, বিশাল ওয়াইন বোতল বখতে-নাসার এবং বন্যা সমৃদ্ধ প্রাচীন মেসোপটেমিয়াকে আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর হিসেবে আমরা সবাই জানি। কিন্তু নতুন নতুন গবেষণা প্রমাণ করছে, সেখানেই বিকশিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম প্রশাসনিক ব্যবস্থাও।
সেটি ছিল এমন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যা থেকে পৃথিবীর প্রথম নগর রাষ্ট্র, তারপর রাজ্য ও অবশেষে বিশাল সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। তাই গণতন্ত্রেরও আঁতুড়ঘর হিসেবে একে অভিহিত করা হচ্ছে।
ল্যুভর মিউজিয়ামের মধ্যপ্রাচ্যের পুরাকীর্তি বিভাগের কিউরেটর অ্যারিয়ান থমাস বলেন, ‘মেসোপটেমিয়ার দীর্ঘ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে একটি স্বতন্ত্র ও অত্যাধুনিক সংস্কৃতির পাশাপাশি রীতি-নীতি, ঐতিহ্য, কাল্পনিক ও পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাও’ ।
‘সুতরাং, আধুনিক সভ্য ও গণতান্ত্রিক মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার রূপকার মেসোপটেমিয়ার মানুষকে অনেক বেশি পরিচিত বলে মনে হয়’।
বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী দু’টির মধ্যবর্তী আধুনিক ইরাক, ইরানের খুযেস্তান প্রদেশ এবং সিরিয়া ও তুরস্কের উত্তরাঞ্চলে গড়ে উঠেছিল মেসোপটেমিয় সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের মধ্যে উম্মেষ ঘটা অতি উন্নত এ সভ্যতার সূচনা হচ্ছিল ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই।
অক্সফোর্ডের অ্যাসমোলিয়ান যাদুঘরের পল কলিন্সের লেখা নতুন বই ‘প্রাচীন ইরান এবং মেসোপটেমিয়া: পর্বতমালা এবং নিচুভূমিসমূহের ব্যাখ্যা’ প্রকাশিত হয়েছে গত মাসে।
কলিন্স ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘মেসোপটেমিয়ান ধর্মগুরু, শিক্ষক ও আমলারা ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। তাদের এ ঐতিহ্যের উত্থান, সবশেষে সাম্রাজ্যের পতন এবং নতুন মানুষ ও ধারণার আগমন সত্ত্বেও মেসোপটেমিয়া একটি স্পঞ্জের মতো ছিল। যখনই নতুন মানুষ এ অঞ্চলে আসেন, মেসোপটেমিয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্য শুষে তা বজায় রাখেন। অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ধর্মগুরু ও আমলারা মেসোপটেমিয় সমাজে আদেশ জারি করতেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতো’।
অ্যারিয়ান থমাসের মতে, ‘মেসোপটেমিয়ার অবস্থান ও তার সাফল্যে অতি সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক সরকার ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে মেসোপটেমিয়ার অধিকার ছিল’।
পল কলিন্সও জানান, মেসোপটেমিয়া ও আধুনিক ইরানের সোনা, রুপা ও তামা সমৃদ্ধ জগ্রোস পর্বতমালার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া ছিল। জগ্রোসের এসব সরঞ্জাম অস্ত্র-শস্ত্র বানাতে আমদানি করা হতো। মেসোপটেমিয়ার বিখ্যাত মিনারগুলো তৈরির উপকরণও ইরান থেকে এসেছিল। এসব বাণিজ্য ও সম্পর্ক জোরদারে মেসোপটেমিয়ায় বিকশিত হয় সামাজিক নেতৃত্ব।
সভ্যতার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত মেসোপটেমিয়া অঞ্চল সমসাময়িক মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন ছিল এবং বহিঃশত্রুদের থেকে খুব একটা সুরক্ষিত ছিল না বলে বারবার এর ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। পরবর্তীতে এখান থেকেই ব্রোঞ্জ যুগে আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয়, ও আসিরীয় এবং লৌহ যুগে নব্য আসিরীয় ও নব্য ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে ওঠে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ সাল পর্যন্ত মেসোপটেমিয়া পার্সিয়ানদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু পরে এ ভূখণ্ডের আধিপত্য নিয়ে রোমানদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। রোমানরাও এ অঞ্চল ২৫০ বছরের বেশি শাসন করতে পারেননি। দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে পার্সিয়ানরা এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত তাদের শাসনেই থাকে। এরপর মুসলিম শাসনামল শুরু হয়। মুসলিম খিলাফত শাসনে এ অঞ্চল পরবর্তীতে ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে।
অ্যারিয়ান থমাস বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সামাজিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও দ্বন্দ্বে সভ্যতা হাতছাড়া ও ধ্বংস হয়ে যায় মেসোপটেমিয়ানদের’।
বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৬
এএসআর