মানব বিবর্তনের ধারায় ‘হোমো স্যাপিয়েনস স্যাপিয়েন্স’ প্রজাতির সদস্য আমরা আধুনিক মানুষেরা। প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন বছর আগে জীবনকাল শুরুর পর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষেরা।
অন্যসব প্রজাতির সম্পূর্ণ জীবাশ্ম আবিষ্কারের মাধ্যমে সেসব মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে জানা গেলেও অনেকদিন ধরে আমাদের কাছে একটি প্রজাতি অধরাই ছিল। হোমো ইরেকটাস্ প্রজাতিটির শরীরের খণ্ড খণ্ড অংশ এর আগে পাওয়া গেলেও পূর্ণাঙ্গ অবয়বের অভাবে এমনকি তারা মানুষ না নরবানর সে বিষয়েও জ্ঞানের শূন্যতা ছিল।
তারা সরাসরি আমাদের পূর্বপুরুষ হওয়ায় এ শূন্যতায় বিবর্তনের ইতিহাস জানাও তাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাচ্ছিল। মাঝের একটি পর্যায় অজানা থাকায় শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ধারাবাহিকতায় সংযোগ ঘটানোও যাচ্ছিল না।
১৯৮৪ সালের একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কারে সে শূন্যতা দূর হয়ে যায়। সেবার উত্তর কেনিয়ার মরুভূমি হ্রদ তুরকানায় পাওয়া যায় এক প্রাগৈতিহাসিক মানবশিশুর সম্পূর্ণ জীবাশ্ম, যা পাল্টে দেয় বিবর্তনবিদ্যার সামগ্রিক জ্ঞান-ক্ষেত্রকেই।
এতোদিন ধরে খুঁজে ফেরা হোমো ইরেকটাস্ মানুষের সম্পূর্ণ কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজিত ও আলোড়িত সারা পৃথিবীকে, যার রেশ ৩২ বছর পরেও আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
সে মারা যায় প্রায় আট বছর বয়সে এবং তার মরদেহ হ্রদের বর্জ্যের মধ্যে ডুবে যায়। সেখানে জীবাশ্মে পরিণত হয়ে ১৫ লাখ বছর ধরে সংরক্ষিত ছিল কঙ্কালটি। তুরকানা হ্রদের উত্তর-পশ্চিম উপকূলবর্তী নারিওকোটমি অংশে তাকে খুঁজে পান বেসিন ইনস্টিটিউটের রিচার্ড লিকির নেতৃত্বে গবেষক দলের সদস্য কামোইয়া কিমিও।
ওই হোমিনিনি শিশু ‘তুরকানা বয়’ তাই ‘নারিওকোটমি বয়’ নামে বেশি পরিচিত।
আবার এর আগে ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ার গবেষকদের আবিষ্কৃত ৩২ লাখ বছর বয়সী জীবাশ্ম হোমো অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস্কেই (ডাকনাম লুসি) আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হতো। হোমো ইরেকটাস্ প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ অববয়ব আবিষ্কার সে হিসেব-নিকেশকেও উল্টে দেয়।
প্রাথমিক প্লেইস্টোসিন সময়ে ২৩ লাখ থেকে ২৪ লাখ বছর আগে উদ্ভব হোমো ইরেকটাস্ প্রজাতির মানুষদের, যারা আনুমানিক ১৭ লাখ বছর আগে এ প্রজাতির সদস্যরা আফ্রিকার ক্রান্তীয় অঞ্চল, ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
আনুমানিক ২ লাখ বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে আমাদের হোমো স্যাপিয়েন্সদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।
লিকি ও তার দল পূর্বপাশের কুবি ফোরা অংশ দিয়ে তুরকানা হ্রদের খনন কাজ শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। তখন এটি একটি বিরাট এলাকা ছিল। গবেষকদেরও ধারণা ছিল, ৪০ লাখ বছর আগের প্রাগৈতিহাসিক তুরকানায় প্রচুর জীবাশ্ম পাওয়া যাবে। এমনকি সমসাময়িক তিনটি মানব প্রজাতি হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেকটাস্ এবং হোমো প্যারানথ্রোপাস্ বোইসেইরা আফ্রিকায় বসাবাস করতো বলে জানা থাকায় এখানে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবাশ্ম পাওয়ারও আশা ছিল।
১৯৭২ সালে লিকির দল ১৯ লাখ বছর বয়সী হোমো রুদোলফেনসিস্ প্রজাতির মাথার খুলি ও কিছু হাড় পান, যা অন্য তিন প্রজাতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে যোগ হয়। এসব হোমো প্রজাতির সহাবস্থান ছিল বলেও প্রমাণিত হয়।
লিকি বলেন, ‘নারিওকোটমি বয়কে আবিষ্কারের পর থেকেই আমাদের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির বিষয়ে জানা সম্ভব হয়’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ জন শিয়াও বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ জীবাশ্ম যেটি মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন ও নতুন আলোকপাত করে’।
‘হোমো ইরেক্টাস আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ ও প্রথম হোমিনিন, যারা আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে অভিবাসিত হয়। তাই প্রাগৈতিহাসিক মানুষের চারপাশে ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কেও জানায় সেটি’।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৬
এএসআর