১৯৭৪ সালের ২৪ নভেম্বর ছিল মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস বদলে দেওয়ার দিন। পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় একদল বিজ্ঞানী সেদিন এমন একটি জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছিলেন, যেটি মানুষের পূর্বপুরুষের নাম-পরিচয় নতুন করে লেখায়।
আবিষ্কারক দলের প্রধান জীবাশ্ম নৃ-বিজ্ঞানী ডোনাল্ড জোহানসন কিশোরীর নাম দেন লুসি। ৩২ লাখ বছর আগের পৃথিবীতে তার বসবাস ছিল। লুসিই আমাদের আদিমাতা।
লুসির কনুইয়ের একটি হাড়, মাথার একটি অংশ, চোয়ালের একটি অংশ এবং কয়েকটি কশেরুকা পাওয়া যায়। এতো পুরনো হাড় এর আগে পাওয়া যায়নি।
লুসিকে একটি নতুন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যার বৈজ্ঞানিক নাম ছিল হোমো অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস্। এ প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ জীবাশ্মও আগে কখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
গবেষণায় প্রমাণিত হয়, অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির মানবই ছিল আমাদের আদি পূর্বপুরুষ। আমাদের নিজের প্রজাতি আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্সরা বিবর্তিত হয়েছে এ প্রজাতি থেকে। ৩৬ লাখ ৬০ হাজার বছর আগে এ হোমিনিডিন প্রজাতির উদ্ভব এবং আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাস্ তাদের পরবর্তী ধাপ।
লুসিই অবশ্য এ প্রজাতির প্রথম আবিষ্কার নয়। ১৯২৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার টং এলাকায় আবিষ্কৃত এ প্রজাতির প্রথম জীবাশ্ম ছিল ‘টং শিশু’। কিন্তু লুসিরই মাধ্যমেই এদের পূর্ণাঙ্গ শরীর আবিষ্কার ও চার বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়।
আমরা প্রথমে লুসিকেই আমাদের সরাসরি পূর্বপূরুষ বলে মনে করতাম। তবে ১৯৮৪ সালে হোমো ইরেকটাস্ বা ইরেক্ট প্রজাতির হোমিনিনি শিশু ‘তুরকানা বয়’ বা ‘নারিওকোটমি বয়’ এর পূর্ণাঙ্গ অববয়ব আবিষ্কার প্রমাণ করে, অস্ট্রালোপিথেকাস্ থেকে স্যাপিয়েন্সে পরিণত হতে মাঝের ধাপ আদি আধুনিক ইরেক্ট পার হয়েছে আধুনিক মানুষেরা।
জোহানসনের মতে, লুসির ছিল অবিশ্বাস্য প্রাচীন অ্যামালগাম ও আরও অনেক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য, যা আগে কখনো অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়নি। অন্য অস্ট্রালোপিথেকাসদের তুলনায় তার মাথার হাড়, চোয়াল, দাঁত ইত্যাদি বানর প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তার মাথার খুলি ছিল অনেক ছোট। এটি শিম্পাঞ্জির মতো বড় ছিল না। তবে পা ছিল অনেকটা আজকের দিনের মানুষের মতো।
জোহানসন তার গবেষণায় আরও প্রমাণ করেন, লুসি সোজা হয়ে হাঁটতো। কারণ, লুসির শ্রোণীচক্রের আকৃতি ছিল সোজা হয়ে চলতে পারা একটি মানুষের মতো। লুসির হাঁটু ও পায়ের কব্জি দেখে তিনি বলেন, দুই পায়ে হাঁটার জন্য তা ছিল উপযুক্ত।
নিউইয়র্কের আমেরিকান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের উইলিয়াম হার্টকোর্ট স্মিথ বলেন, পৃথিবীতে আর কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই যারা মানুষের মতো হাঁটে। ‘হাঁটার ক্ষমতা মানুষের ক্রমবিকাশের মূল চালিকাশক্তি’- লুসির হাঁটার যে দক্ষতা ছিল এ ধারণাকে তা আরও শক্তিশালী করে তোলে।
বানর থেকে আদিম মানুষদের ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণে বড় মস্তিষ্কের আবশ্যক ছিল না। এরও লাখ লাখ বছর পরে আসা ইরেকটাসদের মধ্য দিয়েই মস্তিষ্কের আসল প্রয়োজনীয়তা আমরা উপলদ্ধি করতে পারি। যদিও পরবর্তী সময়ে বড় মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তবু মানুষের হাঁটতে পারার বৈশিষ্ট্য মানুষকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে।
লুসির আবিষ্কার ছিল মানুষের ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজও বিজ্ঞানীরা লুসির কাছ থেকে শিখছেন। জীবাশ্ম নৃ-বিজ্ঞানীরা ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবার জাতীয় জাদুঘরে গিয়ে লুসিকে দেখে আসছেন।
নৃ-বিজ্ঞানীরা ইথিওপিয়ার অদূরে লুসির বাড়ির কাছে প্রতি বছর জীবাশ্ম খনন করেন। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল মিউজিয়ামের ক্রিশ স্ট্রিঞ্জার দাবি করেন, ‘এ এলাকায় আরও অনেক জীবাশ্ম লুকিয়ে আছে, যা এখনো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ সালেই এমন অনেক জীবাশ্ম আমরা দেখতে পাই, যেগুলো লুসির চেয়েও পরিপূর্ণ এবং অনেক পুরনো’।
‘নতুন নতুন এই আবিষ্কারগুলো সত্ত্বেও লুসির অবস্থান মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী হবে’।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬
এএসআর