গসিপিং বা পরচর্চা মানুষের ইতিহাসের শুরু থেকেই শুরু। কথা চালাচালি একটি বিশেষ ও ঘনিষ্ঠ আচরণ, যা বিবর্তনের আদি পর্যায় থেকেই মানুষের চরিত্রে আছে বলেই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
হোমো ইরেক্টাস আমাদের প্রজাতি আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্সদের সরাসরি পূর্বপুরুষ। বিলুপ্ত ইরেক্টদের পাওয়া জীবাশ্ম পর্যালোচনা করে গবেষকরা বলেন, ২ লাখ বছর আগে তাদের মাধ্যমেই মানুষের ভাষা তৈরি হই। তার একটি জিন বর্তমান ফর্মের পরিচায়ক এবং আধুনিক ভাষার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক সংস্করণ। একই সময় আধুনিক মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) উত্থানও শুরু। কিন্তু ভাষার উৎপত্তি না হলেও পরচর্চা চালু ছিল এর আগে থেকেই, তবে একটি বিশেষ ফর্মে। আমাদের সবচেয়ে নিকট আত্মীয় বনমানুষদের সাজগোজ, একে অপরের চুল স্পর্শ এবং অবাঞ্ছিত উকুন খোঁজার সময় মূলত এ কাজ করতে দেখা যায়, যা তাদের প্রায়ই সময়ের অপচয় করে।
এটিকে পরচর্চার প্রমাণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্যের পশম পরিষ্কারে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে। কিন্তু কিছু স্তন্যপায়ী ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মাঝে মাঝে তাদের দিনের এক পঞ্চমাংশ সময় পর্যন্ত এ কাজ করে।
মানব পূর্বপুরুষও একে অপরের সঙ্গে এভাবেই গসিপিং শুরু করে। তবে আমরা কিছু অতিরিক্ত প্রক্রিয়া সংযোজন করি। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রবিন ডানবার বলেন, ‘সকল মানব সমাজ অনর্থক কথা ও পরচর্চার ওপর নির্মিত হয়। পরচর্চার প্রক্রিয়াও বিবর্তিত হয়েছে, ভাষার চেহারাও বদলেছে, কথা চালাচালি দিয়েও একযোগে কয়েকজনের সঙ্গে একই সময়ে সামাজিক তথ্য শেয়ারও করতে শিখেছে মানুষ’।
গসিপিং এর প্রথম সূচনা শিকারে গিয়ে বলে উল্লেখ করে ডানবার জানান, প্রথম দিকে মানুষের অন্যান্য দক্ষতার জন্য বড় মস্তিষ্ক, ভাষা ও বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। পরে বাইরে গিয়ে সফলভাবে খাবার সংগ্রহ ও শিকারে অন্য মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। এ সহযোগিতার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে দলের প্রত্যেক ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করতে হয়। কে শিকার তাড়া করবে, কে এটি ধরবে, কে ভোজ্য গাছপালা সংগ্রহ করবে এবং কে সঠিক পথ দেখাবে- এসব ঠিক করতে পরস্পরের সঙ্গে পরচর্চা শুরু করে তারা। দিনের ভাগে গোড়ার দিকের মানুষ পরচর্চায় মূলত তাদের সময় অতিবাহিত করে এভাবেই টিকে থাকার চেষ্টা চালায়। খাদ্য ও আশ্রয় খোঁজা এবং শিকারিদের আক্রমণ এড়ায়। কিন্তু রাতে তারা খুব সামান্যই ঘুমাতো। সম্ভবত এক মিলিয়ন বছর আগে আগুন আবিষ্কারের পর অন্ধকারের জীবনও পরিবর্তিত হয়।
প্রতি রাতেই একটি ক্যাম্প ফায়ার তাদেরকে উষ্ণতর ও প্রায় নিরাপদ জীবন দেয়। গোড়ার দিকের মানুষেরা তখন আরো অবাধে তাদের অলস সময় কাটানোর একটি ফর্ম হিসেবে পরচর্চাকে বেছে নেয়, যা যোগাযোগকে আরও ত্বরান্বিত করে।
বতসোয়ানার কালাহারি মরুভূমির বুশমেন মানুষদের নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা এ ধারণাকে সমর্থন করছে যে, আধুনিক শিকারিদের আলো ও অন্ধকারের সময়কার কথোপকথনের মধ্যে পার্থক্য ছিল। দিনে কালাহারির ব্যবহারিক বিষয়ে কথা বললেও রাতের বেলা তারা ভিন্নভাবে বলতো। এবং তাদের কথোপকথন গল্প বলার পর্যায়ে উন্নত হয় বলেও আবিষ্কার করেন গবেষকরা’।
বিজ্ঞানীরা নিয়ান্ডারথাল ও তাদের ঘনিষ্ঠ মানুষ আত্মীয় ডেনিসোভানদের জিনোম ও সিকোয়েন্স নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বক্তৃতা দিতে আমাদের যে জিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি সংস্করণ নিয়ান্ডারথালদের মাঝে আছে বলেই প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে টিকামেশ ভাম আশাবাদী যে, আমরা একদিন হোমো ইরেক্টাস্দের ডিএনএতেও এ জিন খুঁজে পেতে পারি। তাহলে প্রমাণ সম্পূর্ণ হবে যে, আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষদের ভাষার জন্যও একই জেনেটিক উপাদান ছিল।
বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৬
এএসআর