দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডের উত্তর দ্বীপ তারাওয়েরার পর্বত সোপানটি রোটোমাহানা হ্রদের বিপরীত তীরে ১০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক সৃষ্টিটিকে কখনো কখনো এমনকি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে বর্ণনা করা হতো।
১৮৮৬ সালের ১০ জুন ভোররাতে তারাওয়েরা আগ্নেয়গিরির বিস্ময়কর বিস্ফোরণ এর ৬৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের ক্রাইস্টচার্চ থেকেও শোনা যায়।
এ অগ্ন্যুৎপাতে পার্শ্ববর্তী ছোট গ্রাম মাওরিসের ১২০ জন বাসিন্দা নিহত হন।
আগ্নেয় বালু সিন্টারের দুই বৃহত্তম মিশ্রণে গঠিত সোপানটিতে একটি অংশে উজ্জ্বল সাদা রং ছিল, যা অজানা রাসায়নিক কারণে একটি গোলাপী অংশের সঙ্গে আলো-ছায়ায় সংমিশ্রিত হতো। উভয় ক্ষেত্রেই নিজস্ব যথার্থতা দিয়ে সহজ একটি ভূ-তাত্ত্বিক স্ফটিক গঠন করেছিল বলে মনে হতো। ফলে পরিপূরক রংগুলো ও তাদের অংশের যোগফলে বৃহত্তর গোলাপী-সাদা সোপানটি তৈরি হয়েছিল, যাতে একে অপরের দৃষ্টিগোচরে দুই ধরনের বিস্ময়কর দৃশ্যাবলীর সৃষ্টি হতো।
অগ্ন্যুৎপাতে গোলাপী-সাদা সোপানটি ধ্বংস হয়ে স্থায়ীভাবে সমাহিত হয়েছিল। এদিকে রোটোমাহানা হ্রদটি উধাও হয়ে গেলেও ধীরে ধীরে একটি নতুন হ্রদ কয়েকভাগে ভাগ হয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। পুরনো হ্রদটি পৃথক হয়ে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ হিসেবে এখনও সেখান থেকে বাষ্পীয় পানি প্রস্ফুটিত হয়।
২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডি রনডি’র নেতৃত্বে জিএসএস এর বিজ্ঞানীরা ধারাবাহিক অভিযানে নতুন রোটোমাহানা হ্রদের অভ্যন্তরে ও পুরনোটির পাদদেশে গবেষণা চালান। অভিযানটি সরাসরি গোলাপী-সাদা সোপান সংশ্লিষ্ট ছিল না। ১৮৮৬ সালের অগ্ন্যুৎপাতে ভূ-প্রাকৃতিক যে সোপান কিভাবে আক্রান্ত হয়, তা আবিষ্কারই দলটির লক্ষ্য ছিল। তবে সোপান ঘিরে কিছু রহস্য উদ্ঘাটন ও নিহতদের কিছু দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়ার আশা করছিলেন গবেষকরা।
চাক্ষুষভাবে পরীক্ষা করার প্রয়োজনে তারা গভীর পানির ক্যামেরা স্থাপন করেছিলেন। যে এলাকায় গোলাপী সোপানটি আগে দাঁড়িয়েছিল, সেখান গঠিত নতুন হ্রদের তলদেশ থেকে তুলে আনা অদ্ভুত ওই বৈশিষ্ট্যের একটি ছবি দেখে মনোযোগী হন তারা। ছবিটিতে তারা দেখেন, হ্রদের তলদেশে সামান্য গোলাপী লাগছিল।
গবেষকরা মনে করলেন, বীচিবিক্ষুব্ধ যে উদ্গত স্তর তারা আবিষ্কার করেছিলেন, সেটি গোলাপী সোপানটির সম্পূর্ণ অংশ না হোক, তার একটি ভগ্নাংশ বা টুকরাও হতে পারে। এ চিন্তা থেকে তারা এর একটি সরাসরি আলোকচিত্র চেয়েছিলেন, যা নির্ধারণ করবে, ওই বৈশিষ্ট্য আসলে গোলাপী সোপানটির একটি অধ্যায় হতে পারে কি-না।
তিন বছর ধরে সার্ভের পর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা সোপানের দেহাবশেষের ওপরে তাদের নৌকা দাঁড় করিয়ে ক্যামেরাটিকে নিচে নামিয়ে হাজার হাজার ছবি তোলেন।
অধিকাংশ ছবিতেই হ্রদের পলল স্তর দেখা গেলেও কয়েকটি ছিল সত্যি সত্যিই গোলাপী সোপানের দেহাবশেষের আলোকচিত্র।
এই ফটোগ্রাফিক প্রমাণ হ্রদের তলায় পাথর ফিটিংয়ের অবস্থানের সঙ্গে মিলিত হয়ে এটি নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল যে, ডি রনডি ও তার সহকর্মীরা সোপানটির একটি অধ্যায় দেখছিলেন। তারা হঠাৎ করেই একটি প্রাকৃতিক আশ্চর্যকে পুনরুত্থিত করেছিলেন।
কিন্তু সেরাটি আসতে তখনও বাকি ছিল। গবেষকরা জলজ ক্যামেরাটি প্রায় ১ কিমি উত্তর-পূর্ব দিকে স্থাপন করেন, যেখানে ১৮৮৬ সালের আগে সাদা সোপানটির আড়াআড়ি অবস্থান ছিল।
বিষ্ময়করভাবে, এবারের ফটোগ্রাফগুলো একসঙ্গে অনেক বিষয় তুলে আনলো। ১৮৮৬ সালের অগ্ন্যুৎপাতের সামনে সাদা সোপানটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল, ক্যামেরা সেখানে ফ্যাকাশে শিলার একটি চাঙড় দেখিয়েছে।
এই দ্বিতীয় উদ্গত স্তর প্রথমবারের চেয়ে আরও স্পষ্টভাবে সোপানের ছাদের মত লাগছিল। একই উল্লম্ব বরাবর সাদাটে শিলার স্তম্ভাকার জমিন অগ্ন্যুৎপাতের আগের সাদা সোপানের ফোটোগ্রাফ বলে প্রমাণ করলো। ডি রনডি এটিকে মোমবাতির মোম ও তার জমিনের সঙ্গে তুলনা করেন।
দলটির অনন্য এ আবিষ্কার রোটোমাহানা হ্রদের তলদেশে বিখ্যাত সোপানটির উভয় টুকরাকে ফিরিয়ে এনেছিল। গোলাপী-সাদা অংশ দু’টি কর্তিত হয়ে নিমজ্জত হয়। শতাব্দীব্যাপী পললের ভেতর দ্বারা সমাহিত ছিল। কিন্তু একরকম অবিশ্বাস্যভাবে তারা আংশিকভাবে ১৮৮৬ সালের অগ্ন্যুৎপাত থেকে মুক্ত হয়েছে।
ভলকানোলজি ও ভূ-গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছবির শিলাগঠিত অংশগুলো অবশ্যই সোপানের টুকরা ছিল। গোলাপী সোপানের মাত্র ১০ শতাংশ টিকে আছে বলে মনে হচ্ছে এবং হোয়াইট সোপানের আরও কম। কিন্তু আসলে গবেষকদের এ আবিষ্কারের অসাধারণত্ব এটিই যে, তারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি প্রাকৃতিক অত্যাশ্চর্যকে তুলে এনেছেন নতুন করে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
এএসআর