২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন বছরের অভিযান শেষে অত্যাশ্চর্য গোলাপী-সাদা সোপানটির ধ্বংসাবশেষের অবস্থানস্থল চিহ্নিত করেন তারা।
কর্নেল ডি রনডি’র নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় রিসার্চ ইনস্টিটিউট জিএসএস এর বিজ্ঞানীরা হ্রদের তলদেশের হাজার হাজার ছবি তুলে আনতে সমর্থ হন।
ছবিতে একটি বৃত্তাকার, পাথুরে সুদর্শন উদ্গত স্তর দেখা যায়, যার এক পাশ থেকে অন্য পাশ আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে নেমেছে। এবং যে অংশ পলিতে ঢেকে যায়নি, সেটির একটি উজ্জ্বল অথচ বিবর্ণ চেহারা ছিল। গবেষকদের চোখে সেটি সামান্য গোলাপী লাগছিল। অন্য একটি আলোকচিত্রে ১৮৮৬ সালের অগ্ন্যুৎপাতের সামনে সাদা সোপানটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল, ক্যামেরা সেখানে ফ্যাকাশে শিলার একটি চাঙড় দেখিয়েছে। এ দ্বিতীয় উদ্গত স্তর প্রথমবারের চেয়ে আরও স্পষ্টভাবে সোপানের ছাদের মত লাগছিল। একই উল্লম্ব বরাবর সাদাটে শিলার স্তম্ভাকার জমিন অগ্ন্যুৎপাতের আগের সাদা সোপানের ফোটোগ্রাফ বলে প্রমাণ করলো।
এভাবেই ১২৮ বছর পরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি প্রাকৃতিক অত্যাশ্চর্যকে বিজ্ঞানীরা তুলে এনেছেন নতুন করে।
পুরনো রোটোমাহানা হ্রদের বিপরীত তীরে ১০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল সেটি। অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক সৃষ্টিটিকে কখনো কখনো এমনকি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে বর্ণনা করা হতো।
১৮৮৬ সালের ১০ জুন ভোররাতে তারাওয়েরা আগ্নেয়গিরির বিস্ময়কর বিস্ফোরণ এর ৬৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের ক্রাইস্টচার্চ থেকেও শোনা যায়।
এ অগ্ন্যুৎপাতে পার্শ্ববর্তী ছোট গ্রাম মাওরিসের ১২০ জন বাসিন্দা নিহত হন।
গবেষক দলের নেতা ভূ-বিজ্ঞানী ডি রনডি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটি দীর্ঘদিন ধরে হারিয়ে থাকা আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের প্রমাণ খুঁজে পাওয়ার মতোই একটি যুগান্তকারী ঘটনা’।
১৮৮৬ সালে রোটোমাহানা হ্রদটি আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে দৃশ্যমান ছিল না। স্থানীয়দের শুধুমাত্র অগ্ন্যুৎপাতের আভাস পাওয়ার সুযোগ নাও হতে পারে। কিন্তু ১১ কিমি পূর্বের গ্রামাঞ্চলের এক ব্যক্তি অগ্ন্যুৎপাতের রাতে হ্রদটির অনিরুদ্ধ দৃশ্যের বর্ণনা দেন।
দুই দিন পরে সাংবাদিক হেনরি বার্ট বলেন, ‘অগ্ন্যুৎপাতের সময় হ্রদটির সঙ্গে একটি বিশাল ফুটন্ত কড়াইয়ের সাড়া জাগানো সমস্ত নির্দেশাবলীর সাদৃশ্য ছিল। অগ্ন্যুৎপাত থেমে গেলে একদিন ভোরে রোটোমাহানা উধাও হয়ে গেল’।
‘ধীরে ধীরে একটি নতুন হ্রদ কয়েকভাগে ভাগ হয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। পুরনো হ্রদটি পৃথক হয়ে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ হিসেবে এখনও সেখান থেকে বাষ্পীয় পানি প্রস্ফুটিত হয়। নবগঠিত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ, যা পুরনো রোটোমাহানার মেঝেতে প্রস্ফুটিত ছিল, এখনও কাদা উদ্গিরণ করে’।
দুই দিন পরে যখন প্রথম অভিযান দল এর ক্ষতির জরিপ করতে আসেন, তারাও দেখেন, পানি আক্ষরিকভাবেই বাতাসে অভিশপ্ত হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল আগ্নেয় ছাইয়ের সঙ্গে কর্দমের মিশ্রণে ১৪ মিটার গভীরে ঢুকে গিয়েছিল।
অগ্ন্যুৎপাতে শুধুমাত্র হ্রদই সর্বস্বান্ত হয়নি, গোলাপী-সাদা সোপানটিসহ এটি যে এলাকায় দাঁড়িয়েছিল, সে এলাকাও আগ্নেয় কাদার শক্ত দলায় পরিণত হয়েছিল। আর সোপানের সিন্টার সাদা অংশ আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে মিশ্রিত পাওয়া যায়।
১৮৮৬ সালের শেষের দিকে গোলাপী-সাদা সোপানটির এলাকা দশ মিটার হ্রদের পানির অধীনে চলে যায়। ফলে সেটি ভবিষ্যতের ভালোর জন্যই পানির তলদেশে হারিয়ে গিয়েছিল।
২০১৪ সালের অভিযান শেষে রনডি’র দল বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অর্জনের ঘোষণা দেন। শেষবারের মতো রোটোমাহানা হ্রদ পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলেন, ‘লেকের ভূ- ব্যবস্থা এখনও সক্রিয়। হ্রদের মেঝে ছিল ৪০০ গুণ পরিবর্তিত, যা একটি গভীর ছন্দময় মানচিত্র উৎপন্ন করেছিল’।
‘নতুন রোটোমাহানায় গোলাপী ও সাদা সোপানের টুকরা আজও থাকায় তাই বোঝা যায় যে, অগ্ন্যুৎপাত দ্বারা ধ্বংস হওয়ার পরে সম্ভবত শিগগিরই এ লেকটি গঠন শুরু হয়’- বলেন রনডি।
চার্লস ব্লোমফিল্ড ঊনবিংশ শতাব্দীতে সোপানটির জলরঙের একটি চিত্র আঁকেন, যেটিও অসাধারণ একটি ধারণা দেয় ডি রনডির দলকে। এটি ব্যাখ্যা দিয়েছে, কেন যে শীতল জুনের সকালের অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা কুখ্যাত হয়ে আছে।
রনডি বলেন, ‘আমাদের ভাগ্য যে, ১২৮ বছর পরের এ আবিষ্কারের মাধ্যমে জগত সৃষ্টির সত্যটা শিখেছি’।
বাংলাদেশ সময়:০৮১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
এএসআর