আনি হচ্ছে উত্তর-পূর্ব তুরস্কের প্রত্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের মধ্যযুগীয় শহর, যা ছিল আর্মেনীয়দের প্রাচীন রাজবংশের রাজধানী, সাবেক আঞ্চলিক শক্তি, মূল বাণিজ্য কেন্দ্র এবং জাতীয় ঐতিহ্য ও সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
৯৬১ থেকে ১০৪৫ সাল পর্যন্ত আর্মেনীয় বাগরাটিড রাজাদের রাজধানী থাকাকালে রাজ পরিবার ও জনগণকে সুরক্ষিত করতে ৯৭৭ সালে নির্মিত হয় শহর প্রাচীরটি।
সে সময়কালে এ শহরে ছিল এক লাখ মানুষের বাস৷ কিন্তু এর দখল নিয়ে শত, শত বছর ধরে চলা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দস্যুতার জেরে তিনশ’ বছর আগে পরিত্যক্ত হয় শহরটি।
বিভিন্ন পর্যায়ে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যাধীন ছিল শহরটি। তাদের কাছ থেকে অটোমানরা দখল করে নেওয়ার পর থেকে মোট তিনশ’ বছরে ছয়টি রাজবংশ আনিকে শাসন করেছিল। অটোমানদের সঙ্গে সঙ্গে জর্জিয়ান, তুর্ক, সেলজুক, বাগরাটিড আর্মেনিয়ানসও আনির সিংহাসনে বসেছিল।
এ শহরের দখল নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল। ১২৩৬ সালে একবার আক্রমণ করে মঙ্গোলিয়ানরা দখলে নিলেও বেশিদিন টিকতে পারেনি। আনি মালভূমি একবার রাশিয়ার হাতেও সমর্পিত হয়েছিল। ১৮৭৭-৭৮ সালে এ নিয়ে বিরোধের জেরে রাশিয়া-তুরস্ক যুদ্ধে আনি’র নিয়ন্ত্রণ হারায় অটোমানরা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর-পূর্বের আনাতোলিয়াসহ আনি দখলে নিতে ফের যুদ্ধে লিপ্ত হয় অটোমানরা। তারা আনি ও পার্শ্ববর্তী এলাকা পুনর্দখলে সমর্থ হলেও ঠিক এ সময়টাতে রিপাবলিক অব আর্মেনিয়া নামে স্বাধীন দেশ গঠিত হলে তার অন্তর্ভুক্ত হয় আনি।
কিন্তু আনি শহর ও তার রাজ্য তাদের প্রাপ্য বলে ফের যুদ্ধ শুরু করে তুরস্ক। ১৯২০ সালে জায়মান তুর্কি প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতার পর চূড়ান্তভাবে আনিকে দখলে নিয়ে আসে তুরস্ক। কিন্তু এরপর থেকে আনি শহরের পতন শুরু।
গত ৯৬ বছরে তুরস্কের কার্স প্রদেশের ৪৫ কিলোমিটার দূরবর্তী আখুরিয়ান নদীর উপত্যকার শহর আনি আজ শুধুই পরিত্যক্ত এবং ভুতুড়ে শহর।
শত শত বছর ধরে আনি শহররক্ষা প্রাচীরটি বিভিন্ন বহিরাগত সৈন্যবাহিনীর অবরোধের পর অবরোধের মুখেও নগরীর বাসিন্দাদের সংরক্ষিত রেখেছে। এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আনি’র অধিবাসীদের কাছে বাগরাটিড ও বাইজেন্টাইন এবং বাইজেন্টাইন ও সেলজুকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সাক্ষীও হয়ে আছে।
আবার ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে নবঘোষিত প্রজাতন্ত্র আর্মেনিয়াজুড়ে সংঘটিত নির্মম যুদ্ধেরও সাক্ষী প্রাচীরটি। ওই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার হাজার হাজার মানুষ গণহত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়।
আনি’র এ শহর প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ তিন শতাব্দী ও পাঁচটি সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ একটি প্যানোরামিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও মিলে যায়।
আনি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আখুরিয়ান নদী। তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার মাঝের সীমানা নদীটিও যুদ্ধ-বিগ্রহের সাক্ষী। আর্মেনিয়া ও নিজের মিত্র আজারবাইজানের সঙ্গে স্থানিক বিবাদের জেরে আখুরিয়ান নদীর পাড় ধরে থাকা সীমান্ত ১৯৯৩ সালে ঘিরে দিয়েছে তুরস্ক।
৩১১ কিলোমিটারের ওই বন্ধ সীমান্ত আজ নাগারনো-কারাবাখ দ্বন্দ্ব এবং একটি কূটনৈতিক নিশ্চলতার স্বাক্ষর হিসেবেও বিদ্যমান।
এদিকে আখুরিয়ান নদীর একটি প্রাচীন সেতুকে ঘিরে দেশ দু’টির প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। সেতুটির গিরিখাত একটি প্রাকৃতিক সীমানা তৈরি করেছে, যার নিচের অংশের পথ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। এখানকার দূষিত বাতাসও তুর্কি-আর্মেনীয় শত শত বছরের বৈরি সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানানসই।
বাংলাদেশ সময়: ৪০৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৭
এএসআর