বিলুপ্ত এ প্রজাতির সদস্যদের সঙ্গে যৌন মিলনের ফলে আমাদের হোমো স্যাপিয়েন্সদের জিনে কিছু বিস্ময়কর ও ভালো দিকগুলো সংযোজিত হয়েছে। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে ৩০ হাজার বছর আগে চিরতরে হারিয়ে গেছে নিয়ান্ডারথালরাই।
বলা চলে, ভালো দিকগুলো বিলিয়ে দিয়ে নিজেরাই বিদায় নিয়েছে ওই প্রাগৈতিহাসিক মানুষগুলো। আধুনিক মানুষের ২৫ হাজারের বেশি জিন আছে। বিলুপ্ত নিয়ান্ডারথালদের জিনোমের সঙ্গে আমাদের জিনোমের তুলনামূলক বিশ্লেষণে গবেষকরা ২০১০ সালে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন, আমরা তাদের ১ থেকে ৪ শতাংশ জিন বহন করে চলেছি, যেগুলো শুভ দিক। তাদের কাছ থেকে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও পেয়েছি।
জার্মানির বিবর্তনমূলক নৃ-বিজ্ঞান ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের লাইপ্ৎসিশ স্তাভান্তে পাবো এবং তার সহকর্মীরা ক্রোয়েশিয়ার ভিনডিজা গুহায় পাওয়া তিনজন নিয়ান্ডারথালের দেহাবশেষের প্রাচীন ডিএনএ নিয়ে ওই গবেষণা করেন, যারা ৩৮ হাজার থেকে ৪৪ হাজার বছর আগে বাস করতো। তারপর আধুনিক মানুষের ডিএনএ’র সঙ্গে তুলনা করেন।
গবেষকরা প্রমাণ পান যে, আধুনিক ইউরেশিয়ানদের জিনে নিয়ান্ডারথালদের কাছ থেকে উর্বর সন্তান-সন্ততি উৎপাদিনের বৈশিষ্ট্যটিও এসেছে।
বিজ্ঞানীরা আধুনিক মানুষ ও নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে ঘটা কথা-বার্তাও সমগ্র ইতিহাস থেকে ক্রমে ক্রমে উদ্ধার করছেন। ২০১৩ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো একজন নারী নিয়ান্ডারথালের উচ্চমানের জিনোম সিকোয়েন্স করেন, যার জীবাশ্ম সাইবেরিয়ার গুহায় পাওয়া। আলতাই নিয়ান্ডারথাল নামে পরিচিত এ জীবাশ্ম থেকে গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে, নিয়ান্ডারথাল জিনোমের ২০ শতাংশ পর্যন্ত আজকের মানুষের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।
এমনকি নিয়ান্ডারথাল জিনোমের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন সিয়াটেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যিহোশূয় আকেই।
গবেষকদের মতে, আমরা প্রত্যেকে আসলে আড়াই শতাংশ নিয়ান্ডারথাল।
পাবো বলেন, ‘আমাদের নিয়ান্ডারথাল জিনগুলো ডায়রিয়া, টাইপ ২ ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতাসহ ক্রোহন জাতীয় কিছু রোগ প্রতিরোধী ও ভালো আচরণের বৈশিষ্ট্য অর্জনে সহায়ক। যেমন- আধুনিক ইউরেশিয়ানদের প্রায় ৮০ শতাংশ জিনের ত্বক ও নখ-চুল গঠনের প্রোটিন ফিলামেন্ট সৃষ্টিকারী কেরাটিন নিয়ান্ডারথালদেরও ছিল’।
‘আমরা শীতল ইউরোপীয় পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার পরে এটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, যা আমাদের ঘামের মাধ্যমে আর্দ্রতা হারাতে সাহায্য করেছে। আমাদের ত্বকের অনেক ফাংশনও এতে সঞ্চালিত হয়’- বলেন আকেই।
জার্মানির বিবর্তনমূলক নৃ-বিজ্ঞান ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের জাঁ জ্যাক হাবলিন বলেন, আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা ত্যাগ করে ইউরোপে আসার পর তারা অপরিচিত এসব রোগের সম্মুখীন হয়। আর নিয়ান্ডারথালরা এর আগের এক লাখ বছর ধরে ইউরোপে থাকায় তারা এসব স্থানীয় রোগ প্রতিরোধের জিনে অভিযোজিত হয়েছিল। মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালদের বংশধর এ অভিযোজনের কিছু উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, যা তাদেরকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে।
আশ্চর্যের বিষয়, জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কিছু জিন আমাদের ধূমপানের প্রবৃত্তিও গড়েছে। পাশাপাশি গড়েছে নিকোট্রিন সহ্যের ক্ষমতা।
নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ বিশ্লেষণ শেষে স্পেনের বার্সেলোনার পম্পেই ফাবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্লেস লালুয়েজা ফক্স বলেন, ‘আমরা যখন শিকারী সংগ্রহকারী ছিলাম, ধূমপান করে দিনের কাজে যাওয়ার স্বাভাবিক অনুশীলন গড়ে ওঠে। আবার দিনভর না খেয়ে থাকায় ডায়াবেটিস্ প্রতিরোধের ইমিউন ক্ষমতা শক্তিশালী হয়’।
তিনি আরও বলেন, ‘আলতাই নিয়ান্ডারথালের লাল চুলের বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত দেয় যে, আমাদের মতোই নিয়ান্ডারথালদের চুলের একাধিক রঙ ছিল। তার মানে, মিউটেশনে তাদের কাছ থেকে এ বৈশিষ্ট্য পেয়েছি আমরা’।
আকেই বলেন, ‘নিয়ান্ডারথাল-আধুনিক মানুষের যৌন মিলন মাত্র ১ হাজার প্রজন্ম আগে ঘটেছে। বিবর্তনে একটি দীর্ঘ সময় লাগে, এক মিলিয়ন বছরে ভিন্ন চেহারা হতে পারে। মাঝে মাঝে মিউটেশনে কিছু পরিবর্তন ঘটে। এসব তাই কেবল একটি অপ্রত্যাশিত সাফল্যও হতে পারে’।
‘আমরা বেঁচে ও পুরো পৃথিবীর নেতৃত্বে আছি, নিয়ান্ডারথাল ও অন্যান্য হোমিনিন প্রজাতি মরে গিয়ে এ সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি দিয়ে গেছে কিছু ভালো দিক, যা আমাদের টিকে থাকতে সাহায্য করেছে’- বলেন পাবো।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৭
এএসআর