এমন ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তার ২৩টি পরমাণু বোমা পড়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ মার্শাল আইল্যান্ডের বিকিনি অ্যাটল দ্বীপে (উপহ্রদপরিবেষ্টক বলয়াকার প্রবাল দ্বীপ)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিজেদের পেশী শক্তির মহড়া দেখাতে দ্বীপটিতে ওই বোমাগুলোর পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
এতো বোমায় ক্ষত-বিক্ষত দ্বীপটির আশপাশে ঘেঁষাও একসময় ছিল দায়। অথচ সেই দ্বীপটিতেই নাকি এখন প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিস্ময় কাজ করছে।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, বিকিনি দ্বীপে উদ্ভিদ ও প্রাণীর অস্তিত্ব তৈরি হচ্ছে। সমুদ্রের নোনাজলে গাড়ির মতো বড় আকৃতির প্রবাল বাড়ছে। বংশবিস্তার করছে হাঙ্গর, রাক্ষুসে ও টুনাসহ অনেক সামুদ্রিক প্রজাতির মাছ। মাটির নিচের তেজস্ক্রিয়তার জন্য নারকেল গাছের পানি খেয়ে বাড়ছে সামুদ্রিক কাঁকড়াগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারিত প্রকৃতির ইতিহাস সমৃদ্ধ সিরিজ ‘বিগ প্যাসিফিকে’ গবেষণাচিত্রে বলা হয়েছে, গবেষকরা বিকিনি দ্বীপের পানির নিচে বোমার আঘাতে সৃষ্ট গর্ত এবং জোড় লাগা হাঙ্গর প্রজাতির ডরসাল কাঁটা বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে কাজ করেছেন।
গবেষকদের মধ্যে অন্যতম স্টেনফোর্ড ইউনিভার্সিটির সামুদ্রিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টিভ পালোমবি ও তার দল। তারা সাগরের পানিতে তেজস্ক্রিয়তার বিষাক্ত প্রভাব নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়া এবং হাওয়াই দ্বীপের মাঝামাঝি মাইক্রোএশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের পরিবেশ সম্পর্কে স্টিভ বলেন, এই অঞ্চলের অন্যান্য দ্বীপের মতোই বিকিনি দ্বীপে সামুদ্রিক উদ্ভিদরাজি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দ্বীপের হ্রদে প্রচুর মাছের ঝাঁক দেখা যাচ্ছে। এরা প্রবালে তাদের ডিম ছাড়ছে।
অধ্যাপক স্টিভ মনে করেন, সাত দশক আগে বোমা ফেলা হলেও এতোকাল একা থাকার পরিবেশ দেওয়ার কারণেই এরা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘটনাবহুল এ জায়গাটি তার ঐতিহাসিক সুরক্ষার (বোমা পরীক্ষণ এলাকা) জন্যই এ সুবিধা পেয়ে গেছে।
আরেক দল গবেষক বলছেন, সমুদ্রে যে প্রবাল রয়েছে সেগুলোর ওপর ওই বোমাগুলোর উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। প্রবালেরা কিভাবে বংশ পরম্পরায় ডিএনএ স্থানান্তর ও পরিবর্তনের মাধ্যমে টিকে থাকে, তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
এই গবেষক দল মনে করছে, তাদের গবেষণা পরিণতিতে পৌঁছালে মানুষের রোগ নির্ণয় সংক্রান্ত কাজে আসবে।
একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক স্টিভ বলেন, বিকিনি দ্বীপে এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কিভাবে সেখানে প্রাণের অস্তিত্বে ফিরে এলো তা নিয়ে গবেষণা করে মানুষের দীর্ঘ জীবন লাভের গবেষণায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, বোমার পর বোমার আঘাতে সমুদ্রে গর্ত সৃষ্টির পরও প্রবালেরা কিভাবে পুনরায় জীবন ধারায় ফিরে এসেছে সেটা গবেষণার বিষয়। আর এর মাধ্যমে ডিএনএ কিভাবে অক্ষত রাখা যায় সে বিষয়ে নতুন তথ্য বের হয়ে আসতে পারে।
অবশ্য এসব ‘আশাবাদী গবেষণা ফলের’ বাইরেও কথা রয়েছে। বিকিনি’র প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণের বিকাশ ঘটলেও জায়গাটিকে এখনো মানুষের জন্য বিপদজনক মনে করা হয়। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, জায়গাটিতে এমন দূষিত পরিবেশগত উপাদান রয়েছে যা আর শোধিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বিকিনির পাশের বাসিন্দাদের সম্পর্কে ‘স্ট্রেঞ্জ গ্লো: দ্য স্টোরি অব রেডিয়েশন’ বইয়ের লেখক টিমোথি জরগেনসেন বলেন, বিকিনের পাশের দ্বীপে যারা বাস করেন তাদের শরীরে উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ রয়েছে। এ কারণে ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকি, বিশেষ করে লিউকোমিয়া ও থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে এখনও।
১৯৪৫ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক বোমা বিস্ফোরণের পর ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের এই অংশে। সবশেষ বোমাটি ছিল হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা বোমার চেয়েও ১১শ’ গুণ বেশি শক্তিধর ও সর্বনেশে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
জিওয়াই/এইচএ/