চিকিৎসকের মৃত্যুর বেঁধে দেওয়া সময় থেকে বেঁচে ফেরা ওই নারীর নাম ভিভিয়ান স্ট্যানসিল। সম্প্রতি তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় নদীর তীরে বসে তার ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করছিলেন আর কান্নায় দু’চোখ ভাসাচ্ছিলেন পানিতে।
তিনি বলেন, আমি কখনোই ভাবিনি, একজন ভালো সাঁতারু হবো। আর জাতীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসরে এতোগুলো পুরস্কারতো একেবারে কল্পনাই করতে পারি না। তারপরও জয় করেছি আমি।
এসময় সাঁতারের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে স্ট্যানসিলের দৃষ্টিহীন চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। তিনি বলেন, পানিই হচ্ছে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। এটাই আমাকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে।
‘সাত বছর বয়সে আমার মা মারা যান। তার মদ্যপায়ী বাবাও অল্পদিনের মধ্যে আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে রেখে যক্ষ্মায় মারা যান। তাই স্কুলে পড়া অবস্থায়ই তার দুই জমজ বোন এবং দুই ভাইয়ের জন্য তাকে বের হতে হয়েছিল জীবিকার সন্ধানে।
তিনি বলেন, একপর্যায়ে ভাই-বোনেরা পৃথক হয়ে গেলাম। বিভিন্ন পরিবার আমাদের দত্তক নিলো। কিন্তু আমাকে তিনটি পরিবার বদল করতে হয়েছে। স্ট্যানসিল আক্ষেপ করে বলেন, গায়ের রঙ বেশি কালো হওয়াতে একটি পরিবার আমাকে ঠিকমতো খেয়ালই করতো না। আমাকে অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে ছোটবেলায়ই।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, ১৯ বছর বয়সে ‘রেটিনিটিস পিগমেন্টসা’ রোগে তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে শুরু করে। যদিও এটা তাদের বংশগত সমস্যা। চোখের রেটিনার কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে তার।
আমেরিকার জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার মতে- সারাবিশ্বে প্রতি চার হাজার জন আক্রান্তদের মধ্যে একজন এই সমস্যায় পড়েন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের অবস্থাও বেশি খারাপের দিকে চলে যায়। এখন তিনি কিছুই দেখেন না। তিনি বলেন, আমি এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তারপরও...।
এতো প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও স্ট্যানসিল কলেজ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে ২০ বছরের বেশি সময় ক্যালিফোর্নিয়ায় রিভারসাইড এবং লং বিচ কিন্ডারগার্ডেনে শিক্ষকতাও করেছেন এই অপ্রতিরোধ্য নারী।
যখন তিনি অবসরে যান তখন ধীরে ধীরে তার ওজন বেড়ে যেতে থাকে। পাঁচ ফুট উচ্চতার স্ট্যানসিল মুটিয়ে ৩১৯ পাউন্ডে পৌঁছেন। সেদিনগুলোতে খুব হতাশ এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি। কোনো ব্যায়াম অনুশীলনে যেতেন না। সবসময় তার কারও না কারও ওপর প্রচণ্ড রাগ হতো।
তিনি এবং তার স্বামী সবসময় বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে কাটাতে পছন্দ করতেন। বন্ধুরা মজা করে তাদের নাম দিয়েছিল ‘দি ইটিং ক্লাব’। স্ট্যানসিল স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই শহরের সবগুলো রেস্তোরাঁই আমাদের পরিচিত। ফ্রাইড চিকেন থেকে শুরু করে রিবসহ খাওয়ার মতো যা কিছু আছে সব কিছুই আমরা খেয়েছি।
পঞ্চাশ বছর বয়সে স্ট্যানসিলের স্বাস্থ্য জটিল আকার ধারণ করে। তার রক্তচাপ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং তিনি ডায়াবেটিস রোগেও আক্রান্ত হন। তার চিকিৎসক তাকে বলেন, ৬০ বছর নাগাদ তিনি মারা যাচ্ছেন। কিন্তু স্ট্যানসিল এভাবে মরতে চাচ্ছিলেন না।
চিকিৎসকের কথা তাকে ভাবায়। এরপর তিনি বাঁচার জন্য নতুন করে পদক্ষেপ নেন।
তিনি তার এই দুর্গতির কথা তার বন্ধুদের জানান। তারা তাকে সাঁতারের পরামর্শ দেন। কারণ সাঁতারে শরীরের চর্বি অনেকটাই দূর হয়ে যায়। তার কোনো বন্ধু-বান্ধব সাঁতার জানতো না। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে একমত হয় যে, স্ট্যানসিলের এছাড়া কোনো উপায় নেই। কেননা, ৩১৯ পাউন্ড ওজনের স্ট্যানসিল তখন ভালো করে হাঁটতেও পারতেন না।
সেসময় স্ট্যানসিলের একদিনের সাঁতার দেওয়ার অভিজ্ঞতাও ছিল না। পরে তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সী এক কোচকে পেয়ে সাঁতার শেখার সুযোগটা লুফে নেন।
স্ট্যানসিল শক্ত হয়ে বলেন, প্রথম দিনের সাঁতারে আমি বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলাম। কোচ বারবার চিৎকার করে বলছিলেন, ‘পানিতে নামো ভিভিয়ান! আমি তোমাকে ডুবতে দেবো না। ’ আমি বললাম, পানি অনেক গভীর। তিনি বললেন, ‘তোমার সেটা দেখার দরকার নেই। ’
‘এতে করে আমি লজ্জা বোধ করলাম। পাগলের মতো পানিতে ঝাঁপ দিলাম। তীরে এসে পৌঁছার জন্য সাঁতারের কৌশলগুলো শিখতে লাগলাম। দৃশ্যটা আমার এতো পছন্দের! আমি এখনও এটি মনে রেখেছি। ’
এ সাঁতারু বলেন, সময়টাতে নারীদের জন্য সাঁতারে অনেক সামাজিক বাধা ছিল। তাই নদীর তীরে কোচকে নিয়ে ভোর ৫টায় যেতাম। যখন কেউ থাকতো না। এছাড়া স্ট্যানসিল ভালো করেই বুঝলেন, খাদ্যাভ্যাস বদলানো ছাড়া তার কোনো বিকল্প নেই। ধীরে ধীরে সবুজ শাক-সবজিতে মন দিলেন তিনি।
একপর্যায়ে ব্যাপক মাত্রায় সাঁতার আর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন তাকে এনে দিলো সুস্বাস্থ্য। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রায় ১০০ পাউন্ড ওজন কমে গেলো তার।
তিনি বলেন, আমার রক্তচাপ এখন আদর্শ মাপের চেয়েও ভালো।
এদিকে, অস্বাভাবিকভাবে সাঁতার চালিয়ে যাচ্ছিলেন স্ট্যানসিল। ওজন কমার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুতই প্রতিযোগিতার আসরে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠছিলেন তিনি। বয়স্কদের জাতীয় আঞ্চলিক আসরে অংশগ্রহণ করে গত ২০ বছরে ২৭১টি পদক জয় করে নিয়েছেন এ নারী। কোমরে দুই বার অস্ত্রোপচার সত্ত্বেও স্ট্যানসিল এখন জাতীয় আসরে শিরোপা জয়ের আশাবাদী।
স্ট্যানসিলের কোচও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি বলেন, ‘স্ট্যানসিলের প্রতিদিনের উদ্যমই তাকে এই অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। ’
স্ট্যানসিল এখন সমাজকে কিছু দিতে চেষ্টা করছেন। বয়স্কদের এবং বাচ্চাদের ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তার সাঁতার প্রশিক্ষণ একাডেমি কাজ করে যাচ্ছে। তার মতে, যে হাঁটতে পারে, টেনিস খেলতে পারে, তার জন্য সাঁতার দেওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। সে যে বয়সেরই হোক।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৮
টিএ