ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

চট্টগ্রামে '৮৩ মধ্য ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম

অশোক সাহা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩
চট্টগ্রামে '৮৩ মধ্য ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম

১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রতিবছর এই দিনটি এলে আমার ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা মনে পড়ে।

 

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয় রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। সেই মিছিল পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যায়, নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। সংগ্রামী ছাত্রসমাজের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়।  

আমি তখন ফটিকছড়ি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক। ছাত্র আন্দোলন থেকে বের হয়ে ১৯৮১ আগষ্টের ১৫ তারিখে নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে আমি ফটিকছড়ি কলেজে যোগ দিই। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটিতে আমাকে সংগঠক করা হয়। কলেজের ফাঁকে পার্টির নির্দেশে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতাম।  আমাদের পার্টি থেকে গাইড করতেন জেলার সাধারণ সম্পাদক কমরেড খোরশেদুল ইসলাম।  

কলেজে লেকচার দিয়ে প্রায়ই শহরে চলে আসতাম। আমাদের সকলের যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল কে সি দে রোডে বাংলা-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি অফিস। সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শফিউল আলম। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর ক্রমে মৈত্রী সমিতি অফিস অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলেরও সমন্বয় কেন্দ্র হয়ে যায় কাজের প্রক্রিয়ায়। লিফলেট বিলি, বিক্ষোভ মিছিলসহ তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি করা হতো মৈত্রী সমিতির অফিস থেকেই।  

ফিরে আসি ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির কথায়। অগ্নিগর্ভ রাজধানী। খবর দ্রুত পৌঁছায় চট্টগ্রামে। সন্ধ্যায় মৈত্রী সমিতি অফিসে আমরা অনেকেই ছিলাম। অফিসের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা বিক্ষোভ মিছিল যাচ্ছিল। আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা দৌড়ে মিছিলে চলে গেলো। খোরশেদ ভাই আমাকে পরামর্শ দিলেন বিক্ষোভ মিছিলের শেষ পর্যন্ত যেন আমি ছাত্রদের সাথে থাকি।  

ছোট মিছিল এগোতে এগোতে বিরাট-বিশাল ছাত্র-জনতার উত্তাল বিক্ষোভ মিছিল হয়ে যায়। চট্টগ্রামের সকল স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কর্মী আর বিক্ষুব্দ জনতার মিশেলে অভূতপূর্ব বিশাল মিছিল। ছিল সকল ছাত্র সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থকদের অসাধারণ উপস্থিতি। আজো মনটা ভরে যায় এ বিশাল মিছিলের একজন ছিলাম আমি। মনে পড়লে আজো আমার প্রাণটা ভরে যায়।  

পুরো শহর লোকে লোকারণ্য। ক্রমে বাড়তে থাকা মিছিল শেষে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মাঠে গিয়ে একত্রিত হয়। সেই মাঠে আমাদের নেতা শাহআলম ভাইয়ের দেখা পেলাম। পরিস্থিতি তো বাস্তবে কঠিন। ওনাকে পেয়ে মনে ভরসা জাগলো। সংগ্রামরত সংগঠনগুলোর ছাত্রনেতাদের বললাম পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করার জন্য। ওরা নিজেদের মধ্যে সুদীর্ঘ সময় নিয়ে নানা দিক নিয়ে আলোচনা করলো।  

সিদ্ধান্ত হলো - ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজ সেনাবাহিনী এবং পুলিশের ব্যারিকেড আর মার্শাল 'ল ভেঙে রাস্তায় নামবে। ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ একটা দল বিশ্ববিদ্যালয় চলে গেলো দলে দলে ছাত্রদের পরদিন শহরে নিয়ে আসার জন্য।  

কারো চোখে কোনো ঘুম নেই, সাধারণ ছাত্রদের, ছাত্রনেতাদের। খুব সকালে হাতে লাঠিসোঠা নিয়ে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ সদলবলে রাজপথে বের হয়ে গেলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য !

সারারাত ছিলাম মেডিকেল কলেজের মাঠে। ছিল আমার সহযোদ্ধারাও। জামসেদ, সেলিম, ইমতিয়াজ পাশা ,বালাগাত, হারুন, মনোয়ার, উৎপল, তৃপ্তিষ, হামিদ খুররম, মশিউর, খোরশেদ সুজন, গিয়াস, সিরাজুল ইসলাম রাজু, শাখাওয়াত জীবন- সবার নাম মনে আনতে পারছি না। ক্ষমা চেয়ে নিলাম। সব সংগঠনের সবাই ছিল অসম সাহসে।  

মিছিল মেডিকেল থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম কলেজের দিকে চলে যায়। সেখানে পুলিশের বাধা। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা এসে পৌঁছাতে পারেনি। অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প নেই। অস্থির পরিস্থিতি, আমরা ছিলাম সামনের সারিতে। বিশাল বিশাল মিছিল জড়ো হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকা যায় কতক্ষন ! আমার পাশে ছিলেন চাকসুর প্রাক্তন ভিপি শ্রদ্ধেয় ফজু ভাই। তিনি আমাকে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিল কখন আসে ঠিক নেই ! তিনি চট্টগ্রাম কলেজের আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমাকে বক্তৃতা করতে বললেন। করলাম বেশ উচ্চকন্ঠে।

পরে পরিস্থিতি বিবেচনা করে মিছিল এগোতে শুরু করলো। শহীদ মিনার পর্যন্ত যেতে যেতে মিছিল আরো বড় হয়ে যায়। জঙ্গিরূপ ধারণ করে। শেষতক মিছিল শহীদ মিনারে সমবেত হয়। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা এসে যায়।  

শহীদ মিনারে বিক্ষুব্দ পরিস্থিতি থাকলেও তেমন কোন নৈরাজ্যকর পরিবেশ ছিল না। একটা বিক্ষোভ সমাবেশ আমরা করছিলাম। মঞ্চে সকল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছিলেন। বক্তৃতা চলছিল।  

হঠাৎ করে কথা নেই বার্তা নেই, একটা বিডিআরের ট্রাক রাজপথে বসা আমাদের সমাবেশের দিকে ধেয়ে আসল। আমরা ছাত্রদের রাস্তা পরিস্কার করে দিতে বলায় তারা আমাদের সম্মান জানিয়ে সরে দাঁড়ালো।  

ট্রাকটা সমাবেশস্থল পার হয়েই সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত গিয়ে বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ করা শুরু করল। সমাবেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। এক ছাত্র মারাত্মক আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে রইলো। চারদিকে কাঁদানে গ্যাস। বিশাল সংগঠিত পরিস্থিতি আর রাখা গেলো না। দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছুটছে সবাই।

সামান্য সময় পর মেডিকেল থেকে খবর এলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে খুন করা হয়েছে। পরদিন সকাল সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হলো। সফল হরতাল হলো।  

সেদিনের ঐতিহাসিক সাহসী সংগ্রামের সহযোদ্ধা যারা জীবনবাজি রেখে অসমসাহসী লড়াই করেছেন, সবার অসামান্য অবদান সংগ্রামকে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। সেদিন দেখেছি উত্তাল তারুণ্যের রুদ্র রূপ, সুগঠিত জঙ্গি সংগ্রাম ! ছিল না নৈরাজ্য, ছিল না হঠকারিতা।  
 
সেদিনের সাথী-সহযোদ্ধাদের সাথে নানা অনুষ্ঠানে, রাজনৈতিক কাজে এখনও আমার দেখা হয়ে যায়। বিশেষত পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর দেশের নানা বৈরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আরো বড় বড় লড়াই-সংগ্রাম আমরা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে করতে চেষ্টা করেছি, এখনো করছি, আরো করতে হবে। লড়াই-সংগ্রাম চলবে।

লেখক : প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও বর্তমান সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা সিপিবি।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।