সুস্থ-সবল দেহের জন্য খাদ্যগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। তবে খাবার খেলেই হবে না, খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার।
এটি এক ধরনের চক্র—ভালো স্বাস্থ্য মানে বেশি উৎপাদন সংঘটন, বেশি মজুরি, বেশি ভোগ এবং ভালো স্বাস্থ্য। ঠিক তেমনি উল্টোটা। সারা বিশ্বে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তোলপাড় হয় মূলত এ কারণেই। সার্বিক মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয় কমায়, যেখানে বেশি মজুরি দিয়ে আগের চেয়ে কম পরিমাণ খাবার ঘরে আসে।
দুই.
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন দুই হাজার ১০০ কিলোক্যালরি পরিমাণ খাদ্যশক্তি গ্রহণ করতে হয়। এতে প্রতি মাসে ব্যয় হওয়ার কথা এক হাজার ৮০০ টাকা। সরকারিভাবে সাধারণত এটিই ফুড পোভার্টি লাইন বা খাদ্য দারিদ্র্যসীমা। অর্থাৎ একজন মানুষ প্রতি মাসে এক হাজার ৮০০ টাকা উপার্জন করতে না পারলে সে খাদ্য-দরিদ্র এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন তার থেকে আশা করা যায় না।
অথচ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক হিসাব অনুযায়ী, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু ব্যয় করতে হচ্ছে তিন হাজার ৫১ টাকা। সে অনুযায়ী, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবারগ্রহণে একজন মানুষের ব্যয় হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। একজন সচ্ছল ব্যক্তির জন্য এটুকু বৃদ্ধি হয়তো তেমন কিছু নয়, কিন্তু একজন দৈনিক শ্রমিকের জন্য তা গলার ফাঁস।
তিন.
এই কিছুদিন আগেও টানা ছয় মাস ধরে ১০ শতাংশের ওপরে ছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। তার আগে ছিল ১২ শতাংশের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কয়েক রকম দরিদ্র আছে : দৈনিক এক হাজার ৮০০ ক্যালরি নিয়ে কেউ দারিদ্র্যসীমার খুব নিচে পতিত; কেউ দারিদ্র্যসীমার একটু নিচে হয়তো দুই হাজার ক্যালরি, আবার কেউ আছে দারিদ্র্যসীমার প্রান্তিক ওপরে নাক ডোবানো অবস্থায়। শেষোক্ত শ্রেণি একটি ঢেউ এলেই ডুবে যায়। আবার প্রান্তিক নিচে যারা, তারা একটু ভালো আবহে দরিদ্র থাকে না। বহু বছর আগে মাহাবুব হোসেন ও আব্দুল বায়েস দেখিয়েছেন, গ্রামবাংলায় ৩৩ শতাংশ খানা এখন দরিদ্র; আবার ৩৩ শতাংশ আজ দরিদ্র নয়, কিন্তু কাল দরিদ্র। মোটকথা, প্রচুর মানুষ আছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাস করলেও অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অর্থনৈতিক সামান্য ধাক্কা বা অভিঘাতেই তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসার জোর আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের আনুমানিক হিসাবে এর পরিমাণ অন্তত দুই কোটি। যেমন—কিছুদিন আগের এক গবেষণা বলছে, গেল এক বছরে প্রায় ৩০ লাখ লোক দরিদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এরাই সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যয় কমিয়ে তা দিয়ে পুষ্টি ব্যয় নির্বাহের চেষ্টাও করছে অনেকে। এই পরিস্থিতিতে এখন রোগবালাই ও অশিক্ষা বেড়ে গিয়ে সামগ্রিকভাবে সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদন সক্ষমতাও কমে আসার জোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চার.
প্রসঙ্গত, বিবিএসের হিসাবে একজন মানুষের দৈনিক ন্যূনতম দুই হাজার ১০০ কিলোক্যালরি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের সেট বা ফুড বাস্কেট গঠিত হয় মৌলিক ১১টি খাদ্যের পরিমিত হিসাব বিবেচনায় নিয়ে। এই ১১ খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, গম, ডাল, দুধ, ভোজ্যতেল, মাছ, মাংস, আলু, অন্যান্য সবজি, চিনি ও ফল। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম ক্যালরি অনুপাতে দৈনিক নির্ধারিত পরিমাণে এসব খাবার খেতে হলে একজন মানুষকে কমপক্ষে এক হাজার ৮০০ টাকা খরচ করতে হবে। এর কম ব্যয়ে একজন মানুষের পক্ষে প্রয়োজনীয় পুষ্টির সংস্থান করা অসম্ভব।
প্রসঙ্গত, আরো একটি ধারণা দেওয়া দরকার আর তা হলো, খাওয়া মানেই কর্মদক্ষতা বা কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি নয়। আমরা প্রতিদিন যে খাদ্য গ্রহণ করি, তার প্রায় ৬০ শতাংশ কাজে লাগে আমাদের শরীরের তাপ, প্রেসার, পালস ইত্যাদি ঠিক আগের মতো রাখার জন্য (ফিক্সড কস্ট) এবং এর বাইরে যত খাব তত কর্মক্ষমতা বাড়বে। আবার বার্ধক্যজনিত কারণে একসময় বেশি খেলেও কর্মক্ষমতা না-ও বাড়তে পারে।
পাঁচ.
সুতরাং গেল কয়েক বছর লাগামহীন মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে বিবিএস সংজ্ঞায়িত এই খাদ্য দারিদ্র্যসীমা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকছে না। সুখের সংবাদ যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন নিম্নমুখী, তবে খাদ্যমূল্যে তেমন কমতি নেই বলে অভিযোগ আছে। পুষ্টিবিদরা বলছেন, ব্যয় বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। ফলে তারা কম কিনছে, কম খাচ্ছে। এতে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সব জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে মানুষ কম কিনে কম খেতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের কষ্ট হচ্ছে। ভাত হয়তো খাচ্ছে, তবে মাছ-মাংস, ফলমূল, দুধ কম খাচ্ছে, যার স্বাস্থ্যগত প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে শিশু-কিশোরদের মধ্যে।
ডব্লিউএফপির তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম ক্যালরি গ্রহণের জন্য নির্ধারিত ফুড বাস্কেটের প্রতিটি উপাদানের মূল্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ জন্য মাথাপিছু প্রতি মাসে তিন হাজার ৫১ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর পেছনে সাম্প্রতিক সময়ে চালের ১৯ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তা ছাড়া মুরগি, ডিম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ও সব ধরনের সবজির মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজনীয় খাদ্যগ্রহণের ব্যয়কে উসকে দিয়েছে। পুষ্টি ব্যয় বাড়ায় দেশে অপুষ্টি ও রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য হলো, কম খাবারগ্রহণের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পুষ্টিহীনতা বেড়ে যায়। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও কমে যায় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। ফলে নানা রকম রোগ-ব্যাধির প্রকোপও বাড়ে এবং জাতীয় উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পায়।
পুষ্টিহীনতার ফলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়। শিশুদের ওজন কমে যায় এবং তারা খর্বাকার হয়ে পড়ে। গর্ভবতী নারীরাও সুস্থ শিশু জন্মদানের ক্ষমতা হারান। হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে একটি স্বাস্থ্যহীন জাতি তৈরি হয়, যা উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস করে অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে দেয়। আবার চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গিয়েও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার তুলনামূলক বেশি বলে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। মূল্যস্ফীতির চাপ ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সংকট তাদের ওপরেই সবচেয়ে মারাত্মক আকারে জেঁকে বসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরতদের হারের চেয়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুক্তভোগীর হার বেশি। অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থানরতরাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ভুগছে।
জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থাটির সাম্প্রতিক আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। আর প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্যে ব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ। ’
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা দুই কোটি মানুষ নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে অনেকে চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যয় কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা দুই কোটি মানুষও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। দ্রুত বাজার পরিস্থিতি ও বিনিয়োগ চাঙ্গা করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও মানুষের প্রত্যাশা আরো বেশি।
ছয়.
খাদ্য সরবরাহ যথাযথ হলেও খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষ হতে পারে—এ কথা অনেক আগেই বলেছিলেন নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। কাজেই খাদ্য উৎপাদনে উন্নতি ঘটেছে ভালো কথা, কিন্তু তা-ই যথেষ্ট নয়। এই খাবার বাজার থেকে কেনার ক্রয়ক্ষমতা থাকতে হবে। এমন সুযোগ আসে দুই প্রান্ত থেকে—কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও জিনিসপত্রের দাম কমানো। এবং আপাতত এই দুটি উপাদানের অভাব দেখছি, আর তাই সর্বত্র উসখুস ভাব।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এসআই