খেলোয়াড় সৃষ্টির প্রথম প্রয়োজন হলো মাঠ। কলকাতায় গড়ের মাঠ আছে; ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রেসকোর্স বেশ কিছু ক্লাব এই গড়ের মাঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পুরানা পল্টন ছিল ঢাকাবাসীর সন্ধ্যাবেলার স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় অবগাহন করে সারা দিনের কাজের ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার এক নিয়মিত ঠিকানা। মহাপণ্ডিতরা এখানে সালামি আর দোকানের মাসিক ভাড়ার লোভে দোকানসহ বানালেন স্টেডিয়াম। দোকান যত বেশি, তত আয়। তাই স্টেডিয়ামটা বড়ই হলো। দেওয়া হলো হকিকে। মাঠ থেকে পশ্চিম গ্যালারি এত দূরে যে ওখান থেকে ছোট হকি বল ভালোভাবে দেখাই যায় না। আর বিকেলের খেলায় সূর্য চোখের ওপর পড়ায় খেলা দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হবেই। আমাদের মাঠের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অনুশীলনের জন্য। ১৯৮৫ সালে এশিয়া কাপ হকি হয়েছিল। বাংলাদেশ হকি দল ছিল হোটেল পূর্বাণীতে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম খেলার ভেন্যু হওয়ায় সেখানে অনুশীলন করতে দেওয়া হতো না। হকি দল অনুশীলনে যেত বুয়েট মাঠে। ১৯৮৫ থেকে ২০২৩। মাঠ সমস্যার কোনো উন্নতি হয়নি। উন্নতি হয়নি কর্তাদের মানসিকতায়।
এক গড়ের মাঠ কলকাতার খেলার অগ্রগতির স্টিম ইঞ্জিনের কাজ করছে। আমরা ধুঁকছি মাঠ খুঁজে বের করতে। সেনাবাহিনীর প্রতিটি ইউনিটের মাঠ আছে। কী সুন্দর পরিকল্পনা। আর আমরা খেলার পরিবেশ নষ্ট করে শুধু দোকানের জন্য স্টেডিয়াম বানাই। যখন পল্টন ময়দানে হকি স্টেডিয়াম হয়নি তখন এই মাঠে ক্রিকেট হতো, হকি অনুশীলন হতো। হ্যান্ডবল, কাবাডি—সব খেলাই ছিল। ‘স্পেস’ বন্ধ করে এক অপ্রয়োজনীয় স্টেডিয়াম বানিয়ে ‘আমও গেল, ছালাও গেল’ অবস্থা তৈরি করা হলো।
মালয়েশিয়ায় দুই-তিনটা ম্যাচ খেলেছি যে স্টেডিয়ামে, সেখানে মাঠের মাঝ বরাবর বসার টিনশেড আর পুরো মাঠ দেয়ালবিহীন। তারা এগোচ্ছে খেলায় আর আমরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘মার্ক টাইম’ করছি। স্টেডিয়াম দোকানসহ এই দোকানের সেলামি আছে, ভাড়া আছে। এই টাকা যায় কোথায় ফেডারেশনগুলোতে টাকার অভাব আছে। স্টেডিয়ামে যখন দোকান আছেই, এই ভাড়া বা সেলামি ফেডারেশনগুলোকে দেওয়া যায় না আমাদের রয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। বঙ্গবন্ধু এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন।
এখানে ফেডারেশনগুলোর দেখভাল করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে কী করে আরো সক্রিয় করে তোলা যায় সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আরো ইতিবাচক ভূমিকা রাখার সুযোগ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়। কাজেই এই প্রতিষ্ঠানটিকে আরো কার্যকর করতে হবে।
আমরা কথায় কথায় বিদেশি কোচ আনি। আমি হকির কথাই বলি। হারুন, মামুনসহ বেশ কিছু বিদগ্ধ কোচ আছেন। আম্পায়ার আছেন আন্তর্জাতিক মানের। সমস্যা একটাই, তাঁদের ওপর আমাদের কর্তাদের আস্থা নেই।
দেশের ক্রীড়া নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথম আলোচনা হওয়া উচিত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থাকা দরকার কি না ফেডারেশন কর্তারা নির্বাচনে জিতে এসে এই পরিষদের জন্য তাঁদের কাজ স্বাধীনভাবে করতে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হন।
ক্রীড়ার সবচেয়ে বিস্ময়, স্বাধীনতার এত বছরেও সরকারি বিকেএসপির মতো লেখাপড়ার সঙ্গে একাডেমি গড়ায় ব্যর্থতা।
বসুন্ধরা গ্রুপ স্পোর্টস কমপ্লেক্স করেছে। এটি দেশের ক্রীড়ার ভবিষ্যৎ গড়ার এক শক্তিশালী অনুপ্রেরণা। আজ বিপথগামী যুবসমাজকে পথে ফেরাতে ক্রীড়াঙ্গনকে এগোতেই হবে। সেমিনারসহ টিভি চ্যানেলে ক্রীড়াকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রয়োজনে আমরা কতখানি শক্তিধর হতে পারি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার প্রমাণ। খেলোয়াড়দের সহযোগিতা করুন, তাঁরা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করবেই।
লেখক: জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাবেক জাতীয় ও সেনাবাহিনী হকি দলের অধিনায়ক