জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ ঝুঁকির সম্মুখীন। এই প্রতিবেদনে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বাস করা শিশুদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইউনিসেফের মুখপাত্র, ‘জ্য জ্যাক সিমন’ সংবাদ সংস্থা এপি-কে বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলের জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, নদী ভাঙনের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু বড় শহরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে তারা সেখানে সব ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ’ উক্ত রিপোর্টে দুর্যোগ ঝুঁকির কারণ স্পষ্টভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক পারিপার্শ্বিকতার সম্পর্ক রয়েছে ওতপ্রোতভাবেই। অনেকটাই রিসাইকেলের মতো; দৃশ্যমান নয়, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণই হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। যা মূলত মনুষ্যকৃত কর্মকাণ্ডের ফলাফল। আর সেই কর্মকাণ্ডের নজির হচ্ছে, অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করা। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো অতিমাত্রায় সিএফসি গ্যাস, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস নির্গমন করছে যুগযুগ ধরেই। এই বিষাক্ত গ্যাসগুলো বিভিন্নভাবেই নির্গমন করছে তারা। দেখা গেছে তার মধ্যে শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ ও খনিজ জ্বালানীর ব্যবহারই প্রধান। এছাড়াও নির্বিচারে বন উজাড় ও নদীশাসন জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাতে সহায়তা করছে। বন উজাড় ও নদী শাসনের জন্য শুধু শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী নয়, দায়ী দ্ররিদ্র কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোও। তবে বেশিরভাগই দায়ী হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিমাত্রার কার্বন নিঃসরণ; যাতে কোন ধরনের সন্দেহ নেই। যার ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন গ্যাসের স্তর ক্ষয়ে যাচ্ছেও দ্রুত।
উল্লেখ্য, ওজোনস্তর হচ্ছে পৃথিবীর জন্য এক ধরনের ফিল্টার। এই ফিল্টারে ছেঁকে সূর্যের প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে বিশুদ্ধ করে পৃথিবীর জন্য ১০-৪২ (কমবেশি হতে পারে) ডিগ্রি সেলসিয়াস পাঠায়। এটি ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর জন্য সহনীয় তাপমাত্রা পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে ওজোনস্তর। তার সঙ্গে অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মি চলে আসছে ভূপৃষ্ঠে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোগব্যাধি বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে টিকতে না পেরে অবলুপ্তি হচ্ছে বিশেষ কিছু প্রাণিকুল।
যদি এমন হতো যে, এ বছরই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, সামনের বছরগুলোতে তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে; তাহলেও একটা ভরসা ছিল। কিন্তু সেই ধরনের আশা গুড়েবালি। কারণ কার্বন নিঃসরণ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলছে। তাতে মেরু অঞ্চলের বরফের চাঁই গলছে দ্রুতগতিতে, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতাও বাড়ছে সেসঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করে বলতে হচ্ছে, শুধু যে বরফগলা জলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা কিন্তু নয়; বিজ্ঞানের সূত্র বলছে, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের আয়তনও বৃদ্ধি পায়। যেমন: ফুটন্ত জলের উচ্চতা স্বাভাবিক জলের চাইতে খানিকটা বেশি হয়। তদ্রুপ সমুদ্রের জলও উষ্ণতার কারণে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সুতরাং আমরা বলতে পারি বরফগলা জল এবং উষ্ণ জলের প্রবাহে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়তই। যার ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চলগুলো।
আমরা জানি, ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের নিচু এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা তাৎক্ষণিক মালুম করা যাচ্ছে না। তবে ক্ষতির পরিমাণ ২০৫০ সাল নাগাদ দৃশ্যমান হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও জানিয়েছেন, ওই সময়ের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে প্রায় ১ মিটারের মতো, তাতে বাংলাদেশ চরম হুমকির সম্মুখীন হবে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে না পারলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে এবং বরফ গলে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
উল্লেখিত তথ্য পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের গবেষণার ফলে বিশ্ববাসী সচেতন হওয়ার যথেষ্ট সুযোগও পাচ্ছেন। যদি সেই সুযোগ কাজে লাগানো না যায়, তাহলে পৃথিবীতে বাস করা আমাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং বেঁচে থাকতে হলে আমাদের পরিবেশ বা জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যগুলো উপলব্ধি করতে হবে। খনিজ জ্বালানির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে সৌরশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। প্রচুর বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। ওজোনস্তরের নিচে প্রচুর কার্বন জমেছে, সেগুলোকে নিঃশেষ করতে হলে গাছ লাগানো ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই। একমাত্র গাছই পারে এই বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে নিতে। সুতরাং সমগ্র বিশ্বের মানুষকে সচেতন হতে হবে এখুনি। একযোগে গাছ লাগাতে হবে বিশ্ববাসীকে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশটা আমার নয়; এই চিন্তা পরিহার করতে হবে অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত দেশগুলোকে। বিষয়টি মাথায় নিয়ে সবাইকে পরিবেশ আন্দোলনে যোগ দিতে হবে। সোচ্চার হতে হবে বিশ্ববাসীকে; তবেই যদি নিস্তার মিলে।
আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আমরা দেখেছি উন্নতবিশ্বের শিক্ষার্থীরা যখন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন, সেই সময় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছেন। বিষয়টা দুঃখজনকই বটে! বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা এখনো পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হননি। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, অনেক উচ্চ শিক্ষিতরাও বিষয়টা বুঝলেও বোঝাতে সক্ষম নন। এসব কিন্তু তাদের অজ্ঞতার কারণেই ঘটছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আগে আমাদের বোঝাতে হবে সবাইকে। সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেই তবে বনায়ন সৃষ্টিতে আগ্রহ বেড়ে যাবে আমজনতাসহ শিক্ষার্থীদের। এ দায়িত্ব নিতে হবে প্রচার মাধ্যমগুলোকে, নিতে হবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও। এ ছাড়াও সমাজের তারকা ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করতে।
আরেকটি বিষয় আমরা লক্ষ্য করছি, আমাদের দেশের তারকা শ্রেণির মানুষেরা পরিবেশ কিংবা জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়ে খুব একটা কথা বলতে দেখা যায় না। তারকাদের ভূমিকা এ বিষয়ে জিরো পার্সেন্ট লক্ষ্য করা যায়। অথচ তারা সভা-সেমিনার করে দেশবাসীকে সচেতন করতে পারতেন; কিন্তু তা তারা করছেন না। কেন করছেন না, সেটা অবশ্য বোধগম্য নয়! তথাপিও আমাদের প্রত্যাশা তারা পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার হবেন, দেশবাসীকে সচেতন করবেন, সামাজিক বনায়ন সৃষ্টিতে অবদান রাখবেন। তবেই তাদের তারকাখ্যাতি সার্থক হবে। এভাবে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে প্রত্যেকেই সোচ্চার হলে সবুজ বিশ্বকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট