ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৫ জুন ২০২৫, ০৮ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

ফাঁকফোকর এবং দারিদ্র্য গণনা

আব্দুল বায়েস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:০৭, জুন ৩, ২০২৫
ফাঁকফোকর এবং দারিদ্র্য গণনা আব্দুল বায়েস

‘আমরা নিশ্চয়ই পরচুলায় পাউডার মাখছি এবং এ জন্যই অনেক মানুষের রুটি নেই। ’

—জে জে রুশো

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে গেল ৯ মাসে বাংলাদেশে অতিরিক্ত প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় চার-পঞ্চমাংশ হলো নারী।

প্রথম কথা, ব্যাপক দারিদ্র্য বেড়েছে এবং তা বৈষম্যমূলক। আচ্ছা, বাংলাদেশের গরিব মানুষের সংখ্যা কত? কত ভাগ মানুষ দারিদ্র্যরেখার নিচে বাস করে? কী হারে দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে প্রতিবছর? এমনতরো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যে অর্থনীতিবিদ তথা সমাজবিজ্ঞানী অঙ্কের আশ্রয় নেন, সেটি আজ সুবিদিত।

তাঁরা যে কাজটি করে থাকেন, তা হচ্ছে বিভিন্ন সূচকের কিংবা দারিদ্র্যরেখার মাপকাঠিতে কিছু অনুপাত বা সংখ্যা বের করা। তবে সূচক বলি আর রেখা বলি, উপসংহার কিন্তু সংখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। অথচ বলা হয়ে থাকে  যে দারিদ্র্যদর্শনে পরিমাপযোগ্য উপাদান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এমন সব উপাদান, যা সাধারণত সংখ্যার নিক্তিতে মাপা যায় না। তার পরও শুধু একটি সংখ্যা বা অনুপাত অনুসন্ধানে গবেষক গলদঘর্ম হচ্ছেন।

তাই যখন অর্থনীতি বিষয়টির ওপর তির্যক সমালোচনার তীর ধেয়ে আসে এই বলে যে ‘ইদানীং’ অর্থনীতি মানে অঙ্ক (এবং সেই হেতু আতঙ্ক!), তখন বোধ হয় খুব একটা কিছু বলার থাকে না।

দুই

এই ইদানীং কথাটিও নাকি প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। উইলিয়াম পেটিকে জীবনযাত্রা পরিমাপের আদি উদ্যোক্তাদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আর জীবনমানের প্রসঙ্গ এলে দারিদ্র্যের কথা তো এসেই যায়।

যা হোক, মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উইলিয়াম পেটিকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি। তিনি অক্সফোর্ডে শারীরবিদ্যার অধ্যাপক আবার গ্নোসামে তিনিই সংগীতের অধ্যাপক। পেটি একটি বিশেষ জাহাজ আবিষ্কার করেছিলেন, যদিও সমুদ্রের ঝড়ে জাহাজটি হারিয়ে যায়। আবার শিশু হত্যার দায়ে ফাঁসি হওয়া এক মহিলার দেহে প্রাণ সঞ্চার করার কারণে তাঁকে সমাজের ক্রুদ্ধ কুখ্যাতি অর্জন করতে হয়। মজার ব্যাপার, উইলিয়াম পেটিকে বর্তমান কালে ব্যবহূত জাতীয় উৎপাদন ও জাতীয় আয় পরিমাপের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘আজকের যাঁরা শুদ্ধতর পরিমাপপন্থী অর্থবিজ্ঞানী, তাঁদের কাছে উষ্ণ উজ্জীবন হতে পারে পেটির সেই সালংকার মন্তব্য : কোনো শব্দ নয়, গুরুত্ব দিতে হবে সংখ্যা বা পরিমাপকে। ’

ওপরের বক্তব্য থেকে পাঠক যেন না ভাবেন ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত রচনা করা হলো। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গরিব মানুষের সংখ্যা কত কিংবা গ্রামীণ খানাগুলোর কত ভাগ গরিব খানা অথবা দারিদ্র্যের প্রকোপ কী মাত্রায় কমছে—এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের অবশ্যই পরিমাপযোগ্য কোনো সূচকের দ্বারস্থ হতে হবে। তবে এটি ঠিক যে সূচক আর অনুপাত দিয়ে অনেক সময় দারিদ্র্যের প্রকৃত অবস্থা বের করা যায় না।

তিন

এমন সমালোচক আছেন, যাঁরা মনে করেন যে গরিব গণনা আর গবাদি পশু গণনা এক অর্থে একই কাজ। শুধু মাথা গুনতে হয়। কিন্তু প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য এই যে খাবার ছাড়াও মানুষের আরো অনেক অভাব থাকে, যা প্রথাগত গণনাপদ্ধতি বিবেচনায় আনতে সক্ষম হয় না।   তা ছাড়া এই পদ্ধতি আপেক্ষিক বঞ্চনার বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে বলে মনে হয় না। তবে স্বীকার করতে হবে যে দারিদ্র্যের বহুমাত্রিকতা স্বীকার করে নিয়ে রচিত মানব উন্নয়ন বা মানব দারিদ্র্য সূচক কিছুটা হলেও এ ধরনের ঘাটতি মেটাতে পেরেছে বলে ধারণা। যেমন—এক গবেষক তিনটি মাত্রিকতা নিয়ে একটি সূচক তৈরি করেছেন; যথা—হ্যাভিং, লাভিং ও বিয়িং। প্রথমটি অর্থনৈতিক সম্পদ (যেমন—ঘর, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা), দ্বিতীয়টি সামাজিক সম্পর্কে তুষ্টি এবং তৃতীয়টি রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, প্রাকৃতিক উপভোগ এবং কাজের তুষ্টি। যা হোক, এমনকি দারিদ্র্যের বহুমাত্রিকতা দেখতে গেলেও একটি নির্ধারিত মান লাগবে দরিদ্র ও অ-দরিদ্রের পার্থক্য করতে। তবে এটি সত্যি (এবং আগেও বলেছি) যে আয়ভিত্তিক পরিমাপ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয় না তার পরও। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও নিম্নে বর্ণিত সূচকগুলো হচ্ছে বহুল ব্যবহৃত গরিব গণনার উৎস এবং নীতিনির্ধারক বা দাতাগোষ্ঠী এই সূচকের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করে থাকে।

দারিদ্র্য পরিমাপের ক্ষেত্রে ‘মাথা গণনা অনুপাত’  একটি বহুল ব্যবহৃত পরিমাপ। সহজ কথায়, এই পরিমাপে সমাজের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য জীবনযাত্রার মান নির্দেশক একটি দারিদ্র্যরেখা স্থাপনা করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োজনীয় ক্যালরি বা ন্যূনতম পুষ্টি এবং বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য  থেকে নির্ধারিত ক্যালরি সংগ্রহের খরচ বাজারদরে নির্ধারণ করা হয়। এই মাত্রার খরচ বা আয়কে দারিদ্র্যরেখা বলে। এবং এই রেখার নিচে বাসরত মোট খানার অংশকে শতাংশে প্রকাশ করে মাথা গণনা সূচক বের করা হয়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম ক্যালরি চাহিদার মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে খাদ্যবহির্ভূত প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর জন্য দারিদ্র্যরেখার সঙ্গে অতিরিক্ত খরচ হিসেবে একটি গুণক ব্যবহার করা হয়।

চার

তাত্ত্বিক বিবেচনা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ নমুনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে সমৃদ্ধ বিশ্বে দারিদ্র্যের অনড় অবস্থানের কারণ খুঁজতে হবে আর্থ-সামাজিক, মেটাবলিক এবং পরিবেশজনিত প্রক্রিয়ার মধ্যে। এই উপাদানগুলো আবার পরস্পর নির্ভরশীল হতে পারে। যেমন—একটি শিশুর সার্বিক উন্নয়নের পথে শিক্ষা, পুষ্টি গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যা হচ্ছে পরিপূরক উপকরণ। এর যেকোনো একটি সরিয়ে দিলে শিশুটির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। পরিপূরক উপকরণের অনুপস্থিতিতে যেকোনো সেবার প্রচ্ছায়া মূল্য নেই বললেই চলে। আমরা জানি, বেঁচে থাকতে হলে মানুষের প্রচুর পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। পুষ্টিগত ভারসাম্য নিয়ে বেঁচে থাকা একজন মানুষ যে পরিমাণ শক্তি গ্রহণ করে, তার বেশির ভাগ (৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ) ব্যয় হয় রক্ষণ কাজে; যেমন—

হৃদস্পন্দন, কিডনি, দৃষ্টিশক্তি ইত্যাদি একই পর্যায়ে ধরে রাখার কাজে। বাকি ৪০ থেকে ২৫ শতাংশ মর্জিমাফিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় হয়। যেমন—কাজ ও বিশ্রাম। মনে রাখা দরকার, শরীরের প্রয়োজনীয় রক্ষণজনিত ব্যয় অনেকটা স্থায়ী খরচের মতো। এই স্থায়ী খরচই একটি দরিদ্র খানার সদস্যদের মধ্যে খাদ্যের অসম বণ্টনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিষয়টি অনেকটা এ রকম : ধরা যাক যে ভারসাম্য পুষ্টির জন্য একজন মানুষের প্রতিদিন গড়পড়তা দুই হাজার ৫০০ কিলো ক্যালরি শক্তি প্রয়োজন। এখন যদি একটি চার সদস্যবিশিষ্ট দরিদ্র খানা প্রতিদিন পাঁচ হাজার ৫০০ ক্যালরি গ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে সদস্যদের জন্য খাদ্যের সমবণ্টন ওই খানাটিকে ধ্বংসের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

পাঁচ

তারা দণ্ডমুক্ততার সঙ্গে সমতা বিধান করতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে বৈষম্যের উৎস হতে পারে দারিদ্র্য। সময়ের আবর্তনে কারো জন্য অপুষ্টিজনিত অবস্থা দারিদ্র্যফাঁদে পড়ার কারণ এবং পরিণতি উভয়ই হতে পারে। যুক্তিটি হলো, অপুষ্টিজনিত অবস্থা হিস্টেরিসিস ঘটাতে (যে ক্ষতচিহ্ন ধ্বংস হয় না) সাহায্য করে এবং এ ধরনের দারিদ্র্য বংশানুক্রমিক হতে পারে : একবার ফাঁদে পড়লে বংশধরদের এর থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে যায়। অর্থনীতি যদি খুব ধনী না হয় এবং সম্পদ বণ্টন খুব অসম থাকে, সে ক্ষেত্রে সম্পদহীন জনগোষ্ঠীর এ ধরনের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি থাকে বেশি। কোনো দেশে বড় মাত্রায় অপুষ্টির অনড় অবস্থান এবং যার জন্য দায়ী অপর্যাপ্ত খাবার, অস্বাস্থ্যকর পায়খানা এবং সুপেয় পানির অভাব নিশ্চিতভাবে ওই দেশটির অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার নির্দেশক। উদাহরণস্বরূপ, কাজ করার ক্ষমতা ব্যাহত হওয়ার ঘটনা শিশুদের মাঝে শক্তিস্বল্পতা ও এনিমিয়ার সুপ্ত খরচ হিসেবে বিবেচিত। শক্তিশূন্যতা ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। মূল্যটি হয়তো বা দিতে হয় পরের বছরগুলোতে, কিন্তু এটি দিতেই হয়।

ছয়

এই ৩০ লাখ নতুন দারিদ্র্যের পেছনে অনেক কারণ আছে, যার মধ্যে অনুমান করি—(ক) সরকারি সেবা খাতে বিপর্যয়; (খ) আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি; (গ) কম প্রবৃদ্ধি এবং (ঘ) স্থবির ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ; (ঙ) জিনিসপত্রের দাম ইত্যাদি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে যে ভবিষ্যতে দরিদ্রের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।