বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সবুজ সুশোভিত ষড়ঋতুর দেশ নামে খ্যাত বাংলাদেশের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা যেমন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে তেমনি ঠাণ্ডাও অনুভূত হচ্ছে ব্যাপক।
এ ছাড়াও বিলম্বিত হচ্ছে শীত, বর্ষার আগমন অথবা অসময়ে ভারি বর্ষণ কিংবা ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে। যেকোন এলাকা মরুকরণের প্রাথমিক আলামতই হচ্ছে এসব। আর এ আলামতটি পরিলক্ষিত হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশেই। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল নামে খ্যাত নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়ায় মরুময়তার লক্ষণ অন্যসব এলাকার তুলনায় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ একটা সময়ে এতদ অঞ্চলের আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। সেই সুষম আবহাওয়া এখন আর বিরাজ করছে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বছর দশেক ধরে গ্রীষ্মকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং শীতে সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলে।
গত ২০১৭ সালের শীত মৌসুমে তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, আর ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে ৪০-৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করেছিল। ২০২২ সালে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে তাপমাত্রার পারদ। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের এপ্রিলেই ৩৯-৪০ ছুঁই ছুঁই করছে। এর আগে ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীর তাপমাত্রা ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল। উল্লেখ্য, কোন এলাকা মরুকরণের জন্য বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাই যথেষ্ট।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত ‘সোনোরান’ মরুভূমির কথা। এটি উত্তর আমেরিকার শুষ্ক ও উষ্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। গ্রীষ্মকালে সেখানকার তাপমাত্রা ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। শীতকালে গড় তাপমাত্রা থাকে ১০-১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতও তেমন সন্তোষজনক নয়। সোনোরান মরুভূমির তাপমাত্রার পরিসংখ্যান মোতাবেক বলা যায়, বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের তাপমাত্রা তারচেয়েও ভয়ানক। রক্ষা পেয়েছে শুধুমাত্র বৃষ্টিপাত এবং যৎসামান্য বনজ সম্পদের কারণে। এখানে ‘সোনোরান’ মরুভূমির তুলনায় বৃষ্টিপাত একটু বেশি বিধায় মরুকরণ প্রক্রিয়া খানিকটা বিলম্বিত হচ্ছে। জলবায়ুর সামগ্রিক পরিসংখ্যানে দৃষ্টি দিলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটি দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্যে মহাবিপদ সংকেত।
বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ নিয়ে বিশ্বের পরিবেশ বিশেষজ্ঞদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে; সতর্কবার্তাও পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। মার্কিন ভূবিজ্ঞানী ড. নারম্যান ম্যাকলিয়ও যিনি সাহারা মরুভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন- তিনি জানিয়েছেন, ‘সাহারা মরুভূমি শুরু থেকে যেভাবে মরুকরণের দিকে এগিয়েছে, ঠিক একই কায়দায় বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বাতাসেও সাহারা মরুভূমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে’। মার্কিন ভূবিজ্ঞানীর দেওয়া এ তথ্যের প্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চল ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, মরুকরণ প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিক ঘটে না, খুব ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের যথেষ্ট সুযোগ থেকে যায়। মানুষকে তাৎক্ষণিক বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাসই আঁচড় কাটে বেশি। কারণ একবার মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও দেখা যায় এটি পরিপূর্ণতা পেতে অর্ধশতাব্দী বা তারও বেশি সময় পেরিয়ে যায়। ফলে বিতর্ক লেগেই থাকে। অর্থাৎ মরুকরণের পরিপূর্ণতা দেখে যেতে হলে একটা মানুষের জীবদ্দশায় তা সম্ভব না-ও হতে পারে। আবার হতেও পারে। সেটি নির্ভর করবে পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে।
জানা যায়, বিশ্বে প্রতিমিনিটে ৪৪ হেক্টর আবাদি ভূমি এবং ২০ হেক্টর বনভূমি মরুকরণ হচ্ছে। সেই হিসেব মোতাবেক দেখা যায়, বছরে ৭০ লাখ হেক্টর জমি মরুকরণ হচ্ছে। মরুকরণের প্রভাবে পড়ে উত্তর আমেরিকার ৪০ শতাংশ আবাদি ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে সাহারার দক্ষিণ অংশে গত ৫০ বছরে ৬ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি গ্রাস করে নিয়েছে মরুভূমি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রতিবছর বিশ্বের কোন না দেশে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা মরুকরণ হচ্ছে। এটি সমগ্র বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর জন্য একটি আতঙ্কজনক সংবাদ। যে সংবাদ ঘটানোর জন্য দায়ী কিন্তু মানবজাতিই; প্রকৃতি নয়। বিশেষ করে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো।
বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদীশাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পেয়ে মেরু অঞ্চলের বড় বড় বরফের চাঁই গলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা একদিকে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে মরুকরণ হচ্ছে পর্যাপ্ত জলের অভাবে অন্য এলাকাগুলো। যার অন্যতম প্রধান শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে দুই মেরুর বরফ গলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, মালদ্বীপ, মুম্বাই, ইন্দোনেশিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি, মার্শাল আইল্যান্ড, মিসরের ব-দ্বীপ অঞ্চল, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও ভিয়েতনামের উপকূলীয় শহর মারাত্মকভাবে প্লাবিত হবে। আর বাংলাদেশ আক্রান্ত হবে দুইভাবে; যেমন- জল বৃদ্ধি এবং জল হ্রাস এ দুটি সমস্যা দেশটিকে মহাদুর্যোগের দিকে ঠেলে দেবে।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে পর্যাপ্ত জল বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রবাহিত না হওয়ায় নদীগুলো শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে এবং তারই প্রভাবে মরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার উৎপত্তি হবে যদি প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। যদিও আপাতত সেটি স্থগিত রয়েছে দুই দেশের সুসম্পর্কের কারণে। জানা যায়, এ বাঁধের দৈর্ঘ্য ১৫০০ ফুট এবং উচ্চতা ৫০০ ফুট। বিশাল এ বাঁধ নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশের সিলেটসহ এক-তৃতীয়াংশ এলাকা এবং ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, আসামের নৌপরিবহন, কৃষি, মৎস্যসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। সিলেট ও মৌলিভীবাজারের ৩৫ হাজার ৩৪৩ হেক্টর জমি বিরান হয়ে যাবে। এ বাঁধের ফলে মরুকরণের পাশাপাশি সমুদ্রের লোনাজল উপরের দিকে উঠে আসবে। এতে সুপেয় জল সংকট দেখা দেবে। যেমন দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলার কারণে। চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে তখন মহাদুর্যোগ। আর জীববৈচিত্র্য পড়বে ভীষণ অস্তিত্ব সংকটে।
উল্লেখিত কারণে বনভূমি বিরান হয়ে দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে আরও দ্রুত। ইচ্ছে করলেও তখন মরুকরণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না কারো পক্ষে। আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনে সতর্ক হতে পারি, তাহলে হয়তো বিপর্যয় কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। ব্যাপকহারে সবুজ বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। যদিও বনবিভাগ ব্যাপকহারে গাছের চারা রোপণ করে বনায়ন সৃষ্টি করেছে তথাপিও সামাজিক বনায়ন সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে বৃক্ষ নিধন বন্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধিরও। তৎসঙ্গে কঠোর আইন প্রয়োগ করে বৃক্ষ নিধনসহ বন্যপ্রাণী নিধনও বন্ধ করতে হবে। নদ-নদী দখল কিংবা জলাশয় ভরাটের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। প্রচুর বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে, কঠোর আইন প্রয়োগ করে বৃক্ষ নিধনসহ বন্যপ্রাণী নিধন বন্ধ করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির সৃষ্টি প্রতিটি সন্তানই কোন না কোনভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নর্দমার কীট থেকে শুরু করে হাতি পর্যন্ত সবাইকে আমাদের প্রয়োজন পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার্থে। এ সত্যটি মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে। মরুকরণরোধে পাখ-পাখালির ভূমিকাও যে অপরিসীম তা-ও জানান দিতে হবে মানুষকে। পাখ-পাখালির কল্যাণে শুধু মরুকরণরোধই নয়, আমরা পাচ্ছি নির্ভেজাল অক্সিজেন ফ্যাক্টরিও; সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও নিস্তার মিলবে আমাদের।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, গত কয়েক বছর আগে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম নজর কেড়েছে আমাদের। শিরোনামটি ছিল, ‘২০৫০ সালের মধ্যে বাসভূমি হারাবে বাংলাদেশের ২ কোটি মানুষ’। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা এক মিটার বাড়লেই দেশের ৪ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যাবে। আর দুই মিটার বাড়লে তলিয়ে যাবে ১২ হাজার ১৫০ বর্গকিলোমিটার। প্রতিবেদনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন পাঠে আশঙ্কা সৃষ্টির পাশাপাশি আমাদের প্রশ্নবিদ্ধও হচ্ছে, আসলেই কি প্রিয় বাংলাদেশ তলিয়ে যাবে! কারণ এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৩-২০০০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের কোন কোন এলাকার ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পেলেও সমুদ্রে উচ্চমাত্রার পলির স্তরের আগমনে ভূমির পরিমাণ বাড়ছে। তাতে ভারসাম্যও বজায় থাকছে। গবেষণার সত্যতাও মিলেছে, যেমন- হাতিয়া অঞ্চলে বিশাল বিশাল চর জেগেছেও ইতোমধ্যে। তবে এটা সত্যি, ভূমির পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং আমরা সময় থাকতে সাবধান হই, নচেৎ এই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা ভীষণ কঠিন হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট