শব্দের স্থিতি ক্ষণস্থায়ী হলেও শব্দ দূষণ মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরিবেশের অন্যসব দূষণের মতো শব্দ দূষণকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে বোঝানো যায় না।
বলা যায়, শব্দ দূষণ মানুষের অসচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। কারণ এখনো অনেকেই জানেন না যে, শব্দ দূষণের ফলে মানুষের কী ধরনের সমস্যা হতে পারে। অথবা যে মানুষটি তীব্র শব্দ দূষণ করে যাচ্ছেন তিনি নিজেও জানেন না যে এটি মারাত্মক অপরাধের আওতায় পড়ে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকেই জানেন না এ অপরাধের কথা। ফলে শব্দ দূষণের শিকার হয়েও আমরা আইনি প্রতিকার পাচ্ছি না যথাযথভাবে।
আমরা জানি, মানুষের শ্রবণযোগ্য শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল। তার পরেও মানুষ অনায়াসে ৬০-৭০ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা সহ্য করে যাচ্ছেন। এ মাত্রার বেশি শব্দ দূষণ হলে মানুষ ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ৮০ ডেসিবেলের অতিরিক্ত মাত্রার শব্দ মানুষের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। তথাপিও আমাদের তা শ্রবণ করতে হচ্ছে। খোদ রাজধানী ঢাকাসহ মফস্বল শহরগুলোতে এই অনিয়ম বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে কিংবা অলিতে-গলিতে সাউন্ড বক্সের আওয়াজ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানো হচ্ছে। টাইলস বসানো, ইট ভাঙার মেশিন কিংবা বড় বড় দালান নির্মাণের ক্ষেত্রে পাইলিং মেশিনের উচ্চমাত্রার আওয়াজ মানুষকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। এছাড়াও উড়োজাহাজের বিকট আওয়াজ মানুষের কানের পর্দার সম্মুখ কোষগুলোতে আঘাত হানার ফলে বড় ধরনের স্পন্দনের সৃষ্টির মাধ্যমে স্নায়ুতন্ত্রে সঞ্চালিত হয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে।
সদরঘাটের চিত্র আরও ভিন্ন। এখানে প্রতিনিয়ত লঞ্চ, ষ্টিমারের ভেঁপু বা সাইরেনের আওয়াজ শুনতে শুনতে মানুষ অর্ধবধির হয়ে গেছে। আসলে দেশের সর্বত্রই একই অবস্থা। রাস্তা-ঘাটে বেরুলেই যত্রতত্র শোনা যায় মাইকিং, ভটভটি বা নছিমন গাড়ির অস্বস্তিকর আওয়াজ, বিয়েশাদিতে উচ্চঃস্বরে গান-বাজনা, স-মিলের বিদ্ঘুটে আওয়াজ। এসব আওয়াজ অনবরত শ্রবণের ফলে মানুষ তার শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলছেন ধীরে ধীরে। এ ধরনের বিরতিহীন শব্দ দূষণের ফলে মানুষ উচ্চরক্তচাপ, শিরঃপীড়া, মানসিক অসুস্থতা, স্নায়ুবিক বৈকল্য, আত্মহত্যার প্রবণতা, আক্রমণাত্মক মনোভাবের উদ্রেক, হৃদরোগসহ নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
অপরদিকে শিশু কিশোরদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে শব্দ দূষণের তাণ্ডবে। শুধু মানুষই নয়, জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও শব্দ দূষণ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অবাধে এ দূষণের শিকার হতে দেখে মনে হচ্ছে দেশে এ বিষয়টা দেখার কেউ নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত এভাবে রাজধানীতে শব্দ দূষণ বাড়তে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নগরীর অর্ধেক মানুষ শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলবেন।
পরিবেশ অধিদফতরের হিসেব মোতাবেক যেকোন শহরের আবাসিক এলাকার শব্দের মাত্রা দিনে সর্ব্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবেল পর্যন্ত সহনীয়। অপরদিকে শয়নকক্ষের জন্য আলাদা পরিমাপ রয়েছে। সেটি ২৫ ডেসিবেলের উপরে অনুমোদিত নয়। রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা থাকবে ৪৫ ডেসিবেল; দিনে ৫৫ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, হাসপাতাল এলাকার ১০০ মিটার পর্যন্ত ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে আইনে উল্লেখ করা আছে। উক্ত এলাকায় রাতে ৪০ ডেসিবেল আর দিনে ৫০ ডেসিবেল পর্যন্ত মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এ সবের ধারেকাছেও নেই নগরগুলোর শব্দের মাত্রা, বরং বহুগুণ শব্দের তাণ্ডবে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। এ পরিমাপ শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, এটি সমগ্র দেশ তথা সমগ্র বিশ্বের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু সেই আইন বাংলাদেশের কেউ-ই মানছে না।
শব্দ দূষণের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যথেষ্ট সোচ্চার। সংস্থাটি এ ব্যাপারে সতর্কবাণী প্রেরণ করছেন বিশ্বের সমগ্র দেশে। শব্দ দূষণের ক্ষতির দিক চিহ্নিত করতে ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাংক একাধিকবার গবেষণায় জড়িত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে ৩০টি জটিল রোগের অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ। তার মধ্যে শব্দ দূষণ অন্যতম। জরিপে দেখা গেছে, শব্দ দূষণের শিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকগণও। সেখানে এরই মধ্যে ১১ শতাংশ লোক তাদের শ্রবণশক্তি হারিয়েও ফেলেছেন। দুর্ভাগ্যজনক সত্যটি হচ্ছে আমাদের দেশে এ ধরনের পরিসংখ্যান না থাকাতে তার সঠিক হিসেব জানা যায়নি আজ অবধি। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনক্রমেই আমাদের দেশে শব্দ দূষণে আক্রান্তের সংখ্যা কম নয়। তাই পরিবেশবিদদের দাবি- শব্দ দূষণে আক্রান্তের সংখ্যা নিরূপণ করে সঠিক পরিসংখ্যান পেশ করা। পাশাপাশি গোটা দেশে পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে শব্দ দূষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং শব্দ দূষণ যে অপরাধ তা গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া; তাতে শব্দ দূষণের মাত্রা অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। শব্দ সন্ত্রাসের বিষয়টি মাথায় রেখে গবেষকরা রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন। তার মধ্যে ইংল্যান্ডের ‘সলফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র প্রকৌশলী ট্রেভর কক্স কিছুটা সফলও হয়েছেন। বাইরের অবাঞ্ছিত উচ্চ শব্দের মাত্রা ঠেকিয়ে রাখতে ভবনের নতুন ডিজাইন আবিষ্কার করেছেন এই শব্দবিষয়ক প্রকৌশলী। শব্দতরঙ্গের দৈর্ঘ্য তৈরি করে অতিরিক্ত শব্দকে ভবনের ভেতরে ঢুকতে বাধা সৃষ্টির করবে তার এই প্রযুক্তিটি। এই প্রযুক্তি সফল হলে বিমানবন্দরের কাছেও মানুষ বসবাস করতে পারবেন, আর শব্দ দূষণ থেকে বিশ্ববাসীও রক্ষা পাবেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট