বন-বনানী, বন্যপ্রাণী ও জলাশয়ের নির্মম পরিণতি দর্শন করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সময় সুযোগের অভাবে দূর কোথাও যেতে না পারলেও মাঝে মধ্যে রাজধানীর কাছেপিঠে ঘুরে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টকারীদের ধৃষ্টতা অবলোকন করি।
মূল কথায় আসছি এবার, গণমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি, ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সাইউ অব সালফার। যা নির্গত হওয়ার ফলে রাজধানীর প্রায় ৫৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটছে। বাদ বাকি বস্তুকণা ও জৈব যৌগ, জ্বালানি দহন ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার মাধ্যমে ঘটছে। বিশেষ করে ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে ঢাকা এবং আশপাশের বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইটভাটার প্রভাবে আশপাশে তুলনামূলকভাবে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে চিমনি দিয়ে নির্গত কালোধোঁয়া প্রবাহিত হওয়া। কালোধোঁয়া এবং অতিরিক্ত কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাসের প্রভাবে আকাশে কোন ধরনের মেঘ পুঞ্জীভূত হতে পারে না বরং আকাশের মেঘকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বৃষ্টিপাতে বিঘ্ন ঘটায়।
ইটভাটার সারি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেলেও বৃহত্তর ঢাকা জেলার সাভার, কেরাণীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে প্রচুর নজরে পড়ে। এমনকি বান্দরবান জেলার পাহাড়সংলগ্ন বনপ্রান্তরেও বেশ কিছু ইটভাটার সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে পাহাড় কেটে কাঁচা ইট বানানো হচ্ছে এবং ইট পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের বৃক্ষরাজি। তাতে পাহাড়ের অস্তিত্ব বিলীনের পাশাপাশি উজাড় হচ্ছে বন-বনানী। জানা গেছে, বছরে কয়েক লাখ ঘনফুট কাঠ পোড়ানো হচ্ছে ভাটাগুলোতে। এ ছাড়াও ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস আশপাশের পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। বিপর্যয় ঘটাচ্ছে ভাটা সংলগ্ন স্কুলের পরিবেশেরও। ইটভাটার মালিকপক্ষ প্রভাবশালী বিধায় স্থানীয় পরিবেশকর্মী কিংবা সচেতন মহল বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদেরও সুযোগ পাচ্ছেন না।
জরিপে জানা গেছে, সমগ্র দেশে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার ৮৮১টি। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৪৮টি বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ভাটাগুলোতে বছরে কয়লা পোড়ানো হয় দুই মিলিয়ন টনেরও বেশি। আর এ থেকে প্রতিবছর কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হয় প্রায় ৮.৭৫ মিলিয়িন টন। এ ছাড়াও ইটভাটা থেকে নির্গত হয় বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ধোঁয়া। যা থেকে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া ঘটে ব্যাপকভাবে। ইটভাটার মালিকরা যদি একটু সতর্ক বা সচেতন হতেন, তাহলে এ ক্ষতিকর দিক থেকে দেশ, জাতি কিংবা পরিবেশটাকে বাঁচাতে পারেন অবলীলায়, সাশ্রয় করতে পারেন নিজেদের অর্থনৈতিক দিকটাও। এর থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে ইটভাটাগুলোকে ইট কারখানায় রূপান্তরিত করা।
এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির কারখানার নাম ‘ইকো ব্রিকফিল্ড’। এটি চালু করেছে ‘কিলন এনার্জি অল্টারনেটিভ’ (সিইএ) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। ইট তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, ‘হফম্যান কিন’ নামক এক ধরনের উন্নত প্রযুক্তি। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে চীনের জিয়াং রিসার্চ অ্যান্ড ডিভাইস ইন্সটিটিউট অব ওরাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস।
জানা যায়, ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরির প্রকল্পটি কয়েক বছর আগে সাভারের ধামরাই উপজেলায় চালু হয়েছিল। ইটভাটার মালিকদের উৎসাহিত করতে প্রকল্পটি হাতে নেয় ‘সিইএ’। এভাবে ইট তৈরিতে ধোঁয়ার সৃষ্টি না হওয়ায় কার্বন নিঃসরণের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। যে সামান্য ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তা সংরক্ষণ করে আবার ব্যবহার করা যায় ড্রায়িং চেম্বারে। ইকো-ব্রিকফিল্ডের বেশ কয়টি আকর্ষণীয় দিক রয়েছে। যেমন মাটি সাশ্রয় হয় ৭০ ভাগ। ইট তৈরির উপযুক্ত মাটির সঙ্গে ৩০ ভাগ কয়লার গুঁড়া মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে মেশিনের সাহায্যে টুকরো করা হয়। ওই টুকরোগুলো সরাসরি ড্রায়িং চেম্বারে ঢুকিয়ে দিলেই মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যেই ইট তৈরি হয়ে যায়। এতে কাঁচা ইট তৈরির ঝামেলা নেই মোটেই। অন্যদিকে পুরনো পদ্ধতিতে ইট পোড়াতে সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন। প্রচুর শ্রমিকেরও প্রয়োজন পড়ে। তাতে অর্থ অপচয় হয় যেমন, তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে চিমনি দিয়ে নির্গত হতে থাকে কালোধোঁয়া। এর প্রভাবে পরিবেশের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা বোধ করি আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। বিশেষ করে সনাতনী পদ্ধতিতে ইট তৈরি করলে খরচ পড়ে বেশি, আর ইকো-ব্রিকফিল্ডের মাধ্যমে খরচ পড়ে কম।
সুখবর হচ্ছে, ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরিতে এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। এর জন্য তারা হাতে নিয়েছে ‘হাইব্রিড হফম্যান কিন’ প্রযুক্তি। এতে খরচ পড়বে অর্ধেকের মতো। সংস্থাটি বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে ১৫টি ‘এনার্জি ইফিশিয়েন্সি কিল্ন’ স্থাপন করবে। আগামী পাঁচ বছর ধরে তারা এ পরীক্ষামূলক কাজটি করবে। জানা গেছে, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ইতিমধ্যে সাভার ও গাজীপুরের কয়েকটি কারখানা চালু করা হয়েছে। পদ্ধতিটি অব্যাহত থাকলে সনাতনী ইটভাটা ইট কারখানায় রূপান্তরিত হবে।
উল্লেখ্য, গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বায়ু দূষণের কারণে উন্নত বিশ্বে এখন আর ইটের ব্যবহার করছে না। তারা বালু-সিমেন্ট ও পাথরের টুকরোর মিশ্রণকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্লক-কাদামাটির সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ যোগ করে ইট তৈরি করছে, যা ওজনেও হালকা।
পরিবেশ অধিদফতর এ ব্যাপারে আধুনিক প্রযুক্তির হাইব্রিড হফম্যান কিল্ন, জিগজ্যাগ কিল্ন ও ভাটিক্যাল শ্যাফ্ট কিল্ন এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা তৈরি করতে মালিকদের উৎসাহিত করেছে। তারা যদি এ সব উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ করেন তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে যেমন, তেমনি লাভবান হবেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই।
মালিকপক্ষ একটু সচেতন হলেই ‘জিগজ্যাগ’ পদ্ধতির মাধ্যমে ইটভাটাকে ধোঁয়াবিহীন ইট কারখানায় রূপান্তরিত করতে পারেন। ইট কারখানায় রূপান্তরিত হলে যেমন বৃক্ষরাজি রক্ষা পাবে, তেমনি কালোধোঁয়া ও কার্বন মনোক্সাইডের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ। অপরদিকে স্বল্পমূল্যে ইট ক্রয়-বিক্রয়েরও সুযোগ তৈরি হবে, পাশাপাশি উপকৃত হবে দেশও জাতি। বেঁচে যাবে অসংখ্য গাছপালাও। কমে আসবে কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও। তাতে গড়ে উঠবে সুন্দর সুষ্ঠ পরিবেশ।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট