স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৫ ও ১৯-এর আলোকে পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সব অঞ্চলের সব নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষ লোকের অভাবপরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয় একজন চেয়ারম্যান, একজন ডেপুটি চেয়ারম্যান ও তিনজন সদস্যের সমন্বয়ে। বরেণ্য অর্থনীতিবিদদের প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় সদস্য করে হয়েছিল উচ্চ পর্যায়ের এই পেশাদার প্রতিষ্ঠান।
সচিব পদমর্যাদার ‘প্রধান’-এর অধীনে মোট ১০টি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়; বিভাগসমূহ ছিল—সাধারণ অর্থনীতি, কার্যক্রম ও মূল্যায়ন, কৃষি, শিল্প, পানিসম্পদ, পল্লী প্রতিষ্ঠান, ভৌত অবকাঠামো, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, বহিঃসম্পদ ও প্রশাসন। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সরকার প্রধানের সভাপতিত্বে এবং অর্থমন্ত্রী (বিকল্প চেয়ারম্যান), পরিকল্পনামন্ত্রী (ভাইস চেয়ারম্যান) ও সচিব মর্যাদার সদস্যদের নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়, যার আর বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। কমিশন অ্যাডভাইজরি, নির্বাহী ও সমন্বয়—এই তিন ধরনের কাজ করে থাকে। সরকারের রুলস অব বিজনেস অনুসারে প্রতিটি বিভাগের কার্যপরিধি সুনির্ধারিত।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের কাজ সম্পন্ন করার জন্য পৃথকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা পরে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) নামে বিভাগে রূপান্তরিত হয়। বহিঃসম্পদ সংগ্রহের দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশন থেকে পৃথক করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষ লোকের অভাবঅধীনে বর্তমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ নামের পৃথক বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের সব প্রশাসনিক ও নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বর্তমানে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিল—এনইসি), যার সভাপতি সরকারপ্রধান আর সব মন্ত্রী/উপদেষ্টা সদস্য, যেখানে ক্যাবিনেট সেক্রেটারিসহ সচিবরা থাকেন সহায়ক কর্মকর্তা।
আবার বহুল আলোচিত একনেক হলো এনইসির নির্বাহী কমিটি, যেখানে ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বের প্রকল্প অনুমোদন হয়ে থাকে।
মন্ত্রিপরিষদসভার মতোই প্রায় নিয়মিত মঙ্গলবার একনেক সভায় প্রকল্প পাসের যে খবর আমরা দেখে অভ্যস্ত, তার সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশন জনসাধারণের নিকট প্রায় সমার্থক। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন হলো কমিশনের কাজের সামান্য অংশমাত্র।
সরকারের রুলস অব বিজনেস অনুসারে কমিশন বহুল প্রচলিত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০ বছর মেয়াদি), বদ্বীপ পরিকল্পনা (১০০ বছর মেয়াদি), এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল), এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল), জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন এবং সেগুলো বাস্তবায়ন মনিটরিং করে থাকে। নানা গবেষণাপত্রও প্রকাশ করে থাকে।
কমিশন সব মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা প্রস্তাবের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত আন্ত মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটিতে আলোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সংযোজন-বিয়োজন শেষে সরকারপ্রধানের সভাপতিত্বে সব মন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত কাউন্সিলে চূড়ান্ত করে। প্রক্রিয়াগত এসব বিষয়ের বাইরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নে বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় কিঞ্চিৎ বৈচিত্র্য নিম্নরূপে আনয়ন বিবেচিত হতে পারে :
প্রথমত, পরিকল্পনা প্রণয়নে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ার লক্ষ্যে বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি কমিটি থাকতে পারে, যারা মাসিক ভিত্তিতে সম্মানি পাবেন কিন্তু কারো অধীন হবেন না। তাঁদের কর্মপরিধি ও সম্মানি সরকার অনুমোদিত হবে।
দ্বিতীয়ত, যদিও বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে তথ্য চাওয়া একটি উপলক্ষ, যার পর মন্ত্রণালয় খসড়া পাঠায়। মন্ত্রণালয় এটিকে একটি গতিময় প্রক্রিয়া হিসেবে চলমান রেখে সদা আপডেটেড থাকার পদক্ষেপ নিতে পারে। ফলে তড়িঘড়ি করে ভবিষ্যৎ অনুমাননির্ভর কাজের তালিকা কমিশনে পাঠানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, মন্ত্রণালয়গুলো কর্তৃক নিজ নিজ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মধ্যবর্তী ও চূড়ান্ত মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা কমিশন কারিগরি পরামর্শ দিয়ে কর্মপদ্ধতি ডেভেলপ করে দিতে পারে।
চতুর্থত, সঠিক পরিসংখ্যান নিশ্চিত করা। সব কালে পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভবিষ্যতে উঠবে না এ রকম কাঠামো কিভাবে করা যায়, যাতে ক্ষমতাসীনদের কালো হাত পরিসংখ্যানকে তাদের ইচ্ছার বস্তুতে পরিণত করতে না পারে? প্রশ্নের উত্তর খুব সোজা কিন্তু বাস্তবায়ন বড়ই কঠিন। অথচ সঠিক পরিকল্পনার অন্যতম ভিত্তি হলো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান।
এবার আসা যাক প্রকল্প প্রসঙ্গে। আমাদের সরকারি দপ্তরগুলো পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে খুব আগ্রহী এমন দাবি করা যাবে না। গবেষক, একাডেমিয়া আর সরকারি দপ্তরগুলোতে এসব প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা, যেমন—বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি নিয়ে রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, এনজিও—এমনকি জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য অংশের অনেক কৌতূহল থাকে। কারণ এতে কে কতটি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছেন তা এলাকায় বা নিজ অধিক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্বের পরিমাপক হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২৩-২৪ সালের এডিপি ২.৬৩ লাখ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেট ৭.৬১ লাখ কোটি টাকার ৩৪.৫ শতাংশ; ২০২৪-২৫ সালের এডিপি ২.৭৯ লাখ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেট ৭.৯৭ লাখ কোটি টাকার ৩৫ শতাংশ। একটি বিষয় লক্ষণীয়, জাতীয় বাজেটের রেভিনিউ অংশ এডিপির দ্বিগুণ হলেও রেভিনিউ অংশ খরচ হয় মূলত সরকারের কিছু রুটিন কাজে; যেমন—বেতন, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি, যার কোনো সরাসরি ফলাফল জনগণ কর্তৃক অনুভূত না। একমাত্র এডিপি বরাদ্দের অংশ থেকে সব ভৌত অবকাঠামো, পরিবহন, রাস্তা, রেল, আকাশ ও নৌপথ যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, সমাজসেবা, শিল্প, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাত উন্নয়নের মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক স্থায়ী কাঠামো তৈরি হয়। সরকারের মিশন, ভিশন, পরিকল্পনা—এগুলোর কোনো অপচয় হয় না। এসব কারণে যতটা আলোচনা হয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে, তার বহুগুণ হয় এডিপি বাস্তবায়ন, প্রকল্পের ব্যয়, মেয়াদ ও প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে। আর এসব কারণে আজকে সরকারের কর্মকাণ্ডে সংস্কার অন্যতম মুখ্য এজেন্ডা হলেও তার পাশাপাশি এডিপি বাস্তবায়ন, প্রকল্প ব্যয় ও মেয়াদের রাশ টেনে ধরা জরুরি। এ ক্ষেত্রে করণীয় হতে পারে, প্রকল্পের বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করা, মাত্রাতিরিক্ত প্রকল্প ব্যয়ের লাগাম টানা, অনুমাননির্ভর প্রকল্প ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া, প্ল্যানিং ক্যারিয়ার গড়তে সচেষ্ট হওয়া।
অবলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডার বিশেষ ক্যাডার হলেও দেশে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টতা যেমন ছিল না, আবার মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রকল্প পরিচালকদেরও পরিকল্পনা বিষয়ে ও প্রকল্প প্রণয়নের অভিজ্ঞতায় বড় রকমের ঘাটতি আছে। এই দুটি সীমাবদ্ধতা উতরাতে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্ল্যানিং ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহীদের পুল করে প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করা সম্ভব। একইভাবে পিডি সিলেকশনের সময় এমন ব্যাকগ্রাউন্ডের পিডি প্রস্তাব করা হয়, যা দেখে প্রস্তাবকারীরা প্রকল্প বাস্তবায়নের টেকনিক্যালিটি অনুধাবন করেন কি না সন্দেহ জাগে।
প্রতি মাসে পরিকল্পনামন্ত্রী/উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৃহৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করে করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের জন্য বাধ্যকর সুপারিশ দিতে পারেন। আইএমইডির সুপারিশ বাস্তবায়নে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বাধ্যবাধকতামূলক করতে হবে। অন্যথায় বিভাগটিকে অকার্যকর করে রাখার দায় কার তা চিহ্নিত করে জনসমক্ষে প্রকাশ করা দরকার।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্থগিত করার পর বর্তমানে ডিপিপিতে প্রকল্পের যৌক্তিকতা সতর্কভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে।
ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ ও প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণে সাম্প্রতিক প্রশংসনীয় উদ্যোগ ফলপ্রসূ করতে হলে প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয়ের বিস্তারিত অঙ্ক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা আবশ্যক। এর ফলে জনরোষের ভয়ে অস্বাভাবিক বেশি ব্যয় প্রস্তাবের কুশীলবদের টনক নড়বে।
তা ছাড়া, সব প্রকল্প অনুমোদনের পর ডিপিপিগুলো পাবলিক স্ক্রুটিনির জন্য কমিশন, মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রাখতে হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্পের সফটওয়্যারের মাধ্যমে সব প্রকল্প দলিলে কমিশন, মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সবার প্রবেশাধিকার রয়েছে; নেই শুধু দেশের মালিক জনসাধারণের। আজকের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বেমানান।
মন্ত্রণালয় ও কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য বিভিন্ন সংস্থার রেট শিডিউলের ভিত্তিতে প্রকল্প ব্যয় বিশ্লেষণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।
খেলাপি ঋণ দুই লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৭ কোটি, বিদেশে পাচার হতো সোয়া লাখ কোটি, আর আমাদের এডিপি মাত্র দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আমরা কত দুর্ভাগা, সেই এডিপিরও অনেক অপচয় হয় দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে। তার ওপর আবার এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এই ধীরগতির প্রভাব নিরসনে এখনই তৎপরতা প্রয়োজন। সম্প্রতি লৌহজাত শিল্পোৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে, যার অন্যতম প্রধান কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি। অর্থবছরের আসন্ন দ্বিতীয়ার্ধে এর প্রভাব নিয়ে ব্যাপক সতর্কতা কাম্য।
কাগুজে পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের বাস্তব কাজে বিস্তর ফারাক। ক্রয় পরিকল্পনা হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনে রয়েছে, অথচ এটি করা হয় না। আইন অনুযায়ী এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। মন্ত্রী, ওপরমহলের তথাকথিত চাপে প্রকল্প প্রস্তাব ও অনুমোদনে বাধ্য না হতে সব শেষে বলতে চাই, স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। কেউ স্বাধীনতা হাতে তুলে দিয়ে যাবে এমন দুরাশাগ্রস্ত কেউ হবেন না। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা কেউ কখনো দিয়ে যায় না; নিজেদের যোগ্যতায় অর্জন করে নিতে হয়।
লেখক: সাবেক সচিব, পরিকল্পনা বিভাগ
(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫