মাঝে মাঝে একটি রাজনৈতিক দলের ছোট সিদ্ধান্ত দলটিকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। একটি অবস্থানই একটি রাজনৈতিক দলকে দেয় অমরত্ব।
গত রোববার (২৩ মার্চ) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে লিখিত মতামতের মধ্যে একটি বিষয়ে বিএনপির অবস্থান গোটা দেশবাসীর হৃদয় স্পর্শ করেছে। দলটি বলেছে, ‘সুপারিশে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনা হয়েছে। এটি তারা সমুচিত বলে মনে করে না। ’ মহান মুক্তিযুদ্ধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বিএনপি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলো।
মহান স্বাধীনতা দিবসের মাত্র ৩ দিন আগে বিএনপির এই অবস্থান টুপি খোলা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। আমাদের গৌরবের মাস। এই মাসে বাঙালি গর্জে উঠেছিল।
যার যা কিছু আছে তাকেই সম্বল করে একটি প্রশিক্ষিত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল বীর বাঙালি। বাংলাদেশ হলো সেই সাহসী সন্তানদের দেশ, যে দেশের মানুষ তার মাতৃভূমির জন্য অকাতরে জীবন দেয়। রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। আমাদের জাতীয় পতাকা ৩০ লাখ শহিদের রক্তে রঞ্জিত। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমিতে আছে শহীদের রক্ত।
এ দেশের বাতাস, বৃক্ষ সবকিছুই শহীদের ত্যাগের সাক্ষী। আমাদের অস্তিত্ব আমাদের স্বাধীনতা। একাত্তর আমাদের সবচেয়ে গর্বের। একাত্তরের সাথে অন্য কোন কিছুর তুলনা হয় না। একাত্তর আমাদের শিখিয়েছে পরাভব না মানতে, একাত্তর আমাদের শিখিয়েছে জনগণের শক্তির বিজয় গাঁথা রচনা করতে। কাজেই একাত্তরকে সবার ওপরে রাখতেই হবে। একাত্তর তুলনাহীন।
আমরা সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করছি যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের গৌরবকে অনেকে ছোট করার চেষ্টা করছেন। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, দুর্ভাগ্যজনক এবং অনভিপ্রেত। একাত্তরের পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ তার ৫৪ বছরের যাত্রাপথে অনেক কিছু অর্জন করেছে। বাংলাদেশ ধাপে ধাপে এগিয়েছে আর্থ-সামাজিক ভাবে। একদিকে যেমন বাংলাদেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছে, বিভিন্ন সময়ে অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সরকারকে জনগণের সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে উৎখাত করেছে, ঠিক তেমনই বাংলাদেশ একটি ক্ষুধা দারিদ্রের রাষ্ট্র থেকে আজ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের মানচিত্রে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশ কৃষিতে গর্ব করার মত সাফল্য অর্জন করেছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের শিল্প এবং বিনিয়োগকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। এ দেশে কৃষকরা যেমন শ্রম ঘাম দিয়ে সোনা ফলিয়েছেন, ঠিক তেমনি ভাবে এ দেশের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা অর্থনীতির চাকাকে সচল করে রেখেছেন। সম্মিলিত সাফল্যের এই ধারায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে অনুকরণীয়।
আমাদের অস্তিত্বের শেকড় একাত্তর। আমাদের ভিত্তি একাত্তর। কাজেই একাত্তরের সঙ্গে অন্য কোন কিছুর তুলনা হয় না। আমরা জানি যে গত বছরের জুলাই মাসে আমাদের শিক্ষার্থীরা এক অভূতপূর্ব গণ আন্দোলন করছে। এই গণ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান ঘটেছে। একটি নতুন বাংলাদেশের প্রত্যয়ে একটি নতুন সরকার যাত্রা শুরু করেছে। এই সরকারের বয়স হয়েছে সাত মাস। কিন্তু এই সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি কিছু অতি উৎসাহীরা একাত্তর আর চব্বিশকে পাশাপাশি রাখতে চাচ্ছে। এনিয়ে জনগণের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও কেউ প্রকাশ্যে কথা বলছিল না। বিএনপি সত্য প্রকাশ করলো। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে উপস্থিত হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ একটাই। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে কোন নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছিল, গণতন্ত্রকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্যেই এই বিজয় অর্জিত হয়েছে। ’
বাংলাদেশ রাষ্ট্র আছে জন্যই চব্বিশের জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। চব্বিশে জুলাই বিপ্লব কি একাত্তরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক? অবশ্যই নয়। যারা মনে করেন যে, জুলাই বিপ্লব মুক্তিযুদ্ধের বিকল্প আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ, তারা অসম্ভব ভুল একটি রাজনৈতিক সমীকরণ করছেন। এই রাজনৈতিক সমীকরণ কখনোই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। চব্বিশের বিপ্লব আসলে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণেরই একটি সংগ্রাম।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা কি ছিল? মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ছিলো একটি সাম্যের বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, যেখানে সকল নাগরিক সমান অধিকার পাবে। একাত্তরে নিরস্ত্র বাঙালি যুদ্ধ করেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ভূখণ্ডের জনগণ প্রতি পদে পদে হয়েছিল বৈষম্যের শিকার। বাঙালিদেরকে সব জায়গায় প্রতিহত করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। আর সেই সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিল তিল করে এদেশের নাগরিকরা সম্মিলিতভাবে একটি অভূতপূর্ব আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলে। একাত্তর এক দিনে হয়নি। ধাপে ধাপে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের নাম একাত্তর। ৪৭ থেকে ৭১ এই যাত্রাপথে অনেক সংগ্রাম, অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত দিতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে সালাম, রফিক, বরকতের রক্ত। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আসাদ, শামসুদ্দোহার সাহসী বলিদান। একাত্তরের যুদ্ধে বীর বাঙালির অকুতোভয় সংগ্রাম এবং জীবন উৎসর্গ করার এক সাহসী দৃষ্টান্ত বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে মুক্তির সোপানে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। একাত্তরে বাংলাদেশ পরাজিত করেছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে। সেই পরাজয়ের ধারায় গত চুয়ান্ন বছরে সব সূচকে পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান এখন বাংলাদেশকে অনুসরণ করে। কেউ যদি মনে করে থাকেন চব্বিশের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে তাহলে সেটা ভুল। দেশের জনগণ কখনো ভুল করে না। সে রকম কোনো দুরভিসন্ধি যদি কারো থেকেও থাকে তাকে প্রতিহত করবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরের যে আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছিল সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুতির কারণে চব্বিশে রাজপথে নেমেছিল জনগণ। আমরা যদি চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানকে নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ। যেটি একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের শহীদ বীররা যে আকাঙ্ক্ষা থেকে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছিলাম। বাংলাদেশ হয়েছিল একটি মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর রাষ্ট্র, যেখানে কিছু ব্যক্তি সব সুবিধা পাবে। কিছু ব্যক্তি রাষ্ট্রের সব সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায়। এরকম একটি অবস্থান থেকে বাংলাদেশ মুক্তি ছিল একাত্তরের চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আর সে কারণেই চব্বিশ হলো মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণের আরেকটি সংগ্রাম মাত্র। এ রকম সংগ্রাম আমরা বারবার করেছি, বিভিন্ন সময় করেছি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও ছিল একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা এবং চেতনার একটি ফসল। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যত লড়াই, যত সংগ্রাম, অপশাসনের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন সবই একাত্তরের চেতনার অংশ। একাত্তর থেকেই আন্দোলনের মূল প্রেরণা উৎসারিত।
আমাদের একটি দুর্ভাগ্য হলো যে, ক্ষমতাসীনরা ইতিহাসকে বারবার নিজেদের মতো করে সাজাতে চায়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দল তার মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বানায়, ইতিহাসের নায়ক সৃষ্টি করে। এটি দুর্ভাগ্যজনক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি দীর্ঘ পরিক্রমা। এই দীর্ঘ যাত্রায় প্রত্যেকের অবদান ইতিহাস নির্ধারিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একাত্তরের অবিসংবাদিত নেতা সেই সেরকমভাবে আমরা খাটো করতে পারি না মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হকের অবদানের কথা। আমরা কোনোভাবেই ভুলে যেতে পারি না ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা। এই সব কিছু মিলিয়েই আমাদের স্বাধীনতা। তারা সবাই স্বাধীনতার অগ্রনায়ক। আমরা এখন ইদানীং লক্ষ্য করছি যে মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়কদেরকে আবার নানা ভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর জিয়াউর রহমান ছিলেন নির্বাসিত। জিয়াউর রহমানকে নির্বাসনে রাখা হয়েছিল কুৎসিত রাজনৈতিক সংকীর্ণতা থেকে। ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসে কারো ভূমিকাকে খাটো করে তার নাম মুছে ফেলা যায় না। এটাই হলো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একজন অকুতোভয় বীর সেনানী ছিলেন, যিনি স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে হতোদ্যম বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম খেতাব’ দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করেছিলেন, তারা যেমন আজ তিরস্কৃত হচ্ছেন ঠিক তেমনি আজকে যদি কেউ শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমেদ কিংবা জাতীয় চার নেতাকে অস্বীকার করতে চান, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানকে খাটো করতে চান, তারাও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। ইতিহাস বড় নির্মম। এখানে যার যে সম্মান সে সম্মানটুকু দিতে হবে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধই আমাদের অস্তিত্ব। এই মুক্তিযুদ্ধ হলো সবার উপরে। স্বাধীনতা হলো আমাদের সবচেয়ে গর্বের। স্বাধীনতার সাথে অন্য কিছুর তুলনা করা যাবে না। একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ অস্তিত্বহীন। আর তাই আমরা চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানকে সম্মান করি। চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান আমাদের জন্য এক বিশাল গর্বের। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারাও আমাদের বাংলাদেশের বীর। কিন্তু তা কখনোই একাত্তরের সঙ্গে তুলনীয় নয়। স্বাধীনতা আমাদের সবার উপরে। স্বাধীনতা ছিল জন্যই আমরা সেই পথ দিয়ে একটি গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সেই গন্তব্য হলো সুখী সমৃদ্ধ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতা দিবস সমাগত। স্বাধীনতাকে আমরা মর্যাদার স্থানে রাখি। বাঙালি জাতি এক সৌহার্দ্যের সম্প্রীতি এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিকশিত হোক এটিই সকলে প্রত্যাশা করে। বাঙালি সংঘাত চায় না, বাঙালি শান্তি চায়, বাঙালি জাতি তার বিকাশ চায়। বাঙালি জাতি প্রাণ খুলে হাসতে চায়। আর সেই হাসি আনন্দের এক সাম্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণই হোক আমাদের লক্ষ্য। আর সেজন্য আমাদের সবার হৃদয়ে একাত্তরকে ধারণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে হবে।
লেখক: অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৫
এসএএইচ