ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ বৈশাখ ১৪৩২, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিনা ভোটে ৫ বছরের হাইপ: ড. ইউনূসকে ডোবাচ্ছেন, না ভাসাচ্ছেন?

মোস্তফা কামাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
বিনা ভোটে ৫ বছরের হাইপ: ড. ইউনূসকে ডোবাচ্ছেন, না ভাসাচ্ছেন?

রোড বা ম্যাপ দৃশ্যমান না হলেও ‘ওই দেখা যায় তালগাছ’-এর মতো নির্বাচন দেখা যাচ্ছে। সহজেই উপলব্ধিযোগ্য যে দেশ নির্বাচনের ট্রেনে উঠে গেছে।

হুইসল বাজলেই ডিসেম্বর বা জুনকে টার্গেট করে ছাড়বে ট্রেনটি। অথবা এর খানিকটা পূর্বাপরেও হতে পারে।

এমন একটি নির্বাচনী সাজ সাজ বাতাবরণের মাঝে ড. ইউনূস সরকারকে আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার হাইপ। তা কি তাঁকে সম্মানিত করার জন্য, না তাঁর মান-ইজ্জত-সম্মান বরবাদ করার জন্য?

ড. ইউনূস যখন প্রথম নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কথা বলেছিলেন, সেটির মধ্যে ডিসেম্বরের আভাসই ছিল। সেনাপ্রধান যখন ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন, সেটি বড়জোর মার্চ মাস পর্যন্ত গড়াতে পারে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সেটিকে টেনে জুনের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

আবার প্রধান উপদেষ্টা একবার বলেছেন মিনিমাম সংস্কার হলে ডিসেম্বর আর ম্যাক্সিমাম সংস্কার হলে জুন। এসব কথার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বর থেকে জুন নির্বাচনের একটি ম্যাপ স্পষ্ট হয়। জরুরি প্রয়োজনে তা আরো দু-এক মাস পেছালেও কোনো দল বা মহলের সম্ভবত তেমন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ড. ইউনূস সরকারকে অন্তত আরো পাঁচটি বছর রেখে দেওয়ার হাইপ তোলা মোটাদাগের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

কারা এই হাইপের আরোপকর্তা? কী তাদের উদ্দেশ্য-বিধেয়?

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এখনতক নিজ মুখে পাঁচ বছর ক্ষমতার অভিপ্রায় জানাননি। আকারে-ইঙ্গিতেও নয়, বরং তিনি তাঁর পূর্বপেশায় সহকর্মীদের কাছে দ্রুত ফেরত যাওয়ার অপেক্ষার কথা বলেছেন একাধিকবার। কিন্তু ভজকট পাকছে দু-একজন উপদেষ্টা এবং তাঁকে ক্ষমতায় আনার পাটাতন নামে অভিহিত নতুন সংগঠন এনসিপির কয়েক নেতার কথায়। একজন উপদেষ্টা বলেছেন, জনগণ চায় তাঁরাই আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুন। পরে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, এটি তাঁর কথা নয়।

তাঁকে চলতিপথে রাস্তায় জনগণ এ কথা বলেছে। এতে বিষয়টি একটু হলেও হালকা হয়ে আসতে থাকে। কথার কথা বা বাতকেবাত মনে করার অবস্থা হয়। কিন্তু আরেকজন উপদেষ্টার কথায় বাধে গোলমাল। তিনি বলে বসেছেন, তাঁরাও নির্বাচিত। কেমন কথা এটি? কবে নির্বাচন হলো, ভোট হলো—এই প্রশ্ন আপনা-আপনিই সামনে চলে আসে। গুণগত-মানগতভাবে কথাগুলো লোক হাসানো হাছান মাহমুদ-ওবায়দুল কাদের স্কেলের কথা।

ড. ইউনূসকে কেউ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় দেখতে চাইতেই পারে। এ জন্য তাদের আক্রমণ করার কিছু নেই। কিন্তু তাঁকে জনগণের সমর্থন নিতে বলার জন্য আক্রমণ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মতের সঙ্গে না মিললে কিছু মানুষ উগ্রতার পরিচয় দেয়। শেখ হাসিনা ১৫-১৬ বছর অন্যায় করেছেন, ড. ইউনূস ১৫-১৬ বছর গদিতে বসে লেভেল লেভেল প্লেয়িং অবস্থা ফিরিয়ে আনুন—এমন তত্ত্ব ছড়ানোর লোকও মিলছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বাদ দিলেও বিশ্বজুড়ে ভিন্ন উচ্চতার মানুষ। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করছেন বিশ্বজুড়ে। আওয়ামী লীগ ও এর আজ্ঞাবহ ছাড়া কেউ ড. ইউনূসের বিপক্ষে নয়। জাতীয়তাবাদী শক্তি, দেশপ্রেমিক ডান-বাম, ছাত্র-তরুণ মিলিয়ে সবাই তাঁর সমর্থক।  কেউ তাতে মুগ্ধ, কেউ অভিভূত। তিনিসহ তাঁর পরিষদের কয়েকজনের গুণপনায় দেশ-বিদেশ রীতিমতো বশীভূত। তাঁদের যোগ্যতায়, দক্ষতায়, জাদুকরী নৈপুণ্যে শিহরিত। বিশেষ করে ড. ইউনূস সর্বজনীন, তিনি সবার। এমনকি তিনি কেবল বাংলাদেশের নন, তিনি সারা বিশ্বের। এমন একজন ব্যক্তি নিজে বা তাঁর পছন্দের কেউ যদি তাঁকে পাঁচ বছর, ১০ বছর নয়, আজীবনও ক্ষমতায় দেখতে চায়, তা দোষের নয়। সে ক্ষেত্রে তাঁকে বা তাঁদের অবশ্যই জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে। সেটি হবে তাঁদের জন্য সম্মানের।

সেই সুযোগ তো আছেই। নির্বাচন টার্গেট করে তাঁরা সেই প্রস্তুতি নিতে পারেন। দল গঠন করতে পারেন। নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করে তাঁরা ভোটের মাঠে লড়বেন। সত্যি সত্যি মানুষ চাইলে ফ্রি-ফেয়ারে, ইজ্জতে-হুরমতে বিপুল ভোটে তাঁরা জিতবেন। ক্ষমতায় বসবেন। নিজে নিষ্কণ্টকভাবে সম্মানিত হবেন। দেশকেও সম্মানিত-মহিমান্বিত করবেন। কেউ আর অনির্বাচিত বলে টীকা-টিপ্পনী কাটতে পারবে না। পরাজিত বাদবাকি দলগুলো চাইলেও কড়া কোনো বিরোধিতা করতে পারবে না। করলেও তা হালে পানি পাবে না। মানুষ ইউনূস ও তাঁর পার্টিকেই বুকে আগলে রাখবে। সাবলীল এ পথে না গিয়ে বিনা ভোটে তাঁদের আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার চিন্তাটি কি শুভ বা সৎ, নাকি ড. ইউনূসকে জনমের তরে  ডোবানোর? নইলে কেন বিনা ভোটে তাঁকে আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার দুষ্ট চিন্তা? কোন মতলবে ‘মার্চ ফর ড. ইউনূস’ ধরনের হাস্যকর কর্মসূচি?

বিষয়টি পরিষ্কার করার বিশেষ দায়িত্ব এখন সরকারের। প্রধান উপদেষ্টার নিজেরও। সন্দেহের একটি জায়গা ছাত্রদের সংগঠন এনসিপি থেকে বলা হয়েছে, আগে সংস্কার, পরে নির্বাচনসহ কিছু দাবি করলেও মার্চ ফর ইউনূস বা বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসকে বিনা ভোটে আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার এমন আয়োজনে তারা নেই। চেতনে-অবচেতনে আজকে যারা ড. ইউনূসকে মাথায় তুলে এ ধরনের কাণ্ড করছে, তারা তাঁকে অজনপ্রিয় ও বিতর্কিত করার রিহার্সালে নেমেছে, যা তাঁর সমগ্র অর্জন ধুলায় মেশাতে টেকসইভাবে কাজে দেবে। এই তামাশা অবিলম্বে বন্ধ হোক। সরকারের বা বাইরের কারো এই কুকর্মে ইন্ধন বা সংযোগ থাকলে এখনই এর বিহিত করা জরুরি। সময় কিন্তু দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, ডিসেম্বর টাইমলাইন ধরে প্রস্তুতি চলছে তাদের। সেই লাইনটি জুন হলেও হাতে সময় অনেক নেই। যেনতেন বা করার জন্যই করা নির্বাচন হলে ভিন্ন কথা। তা আগামী মাসেও করা যায়। ধরো তক্তা মারো পেরেকে, দিনের ভোট আগের রাতে বা ডামি-স্বামী-আমি মিলিয়ে ঝটপট ভোট করে ফেলার এক্সপার্ট লোক বহু আছে। বিনা ভোটে ১৫৩ কেন, ৩০০ আসনের ফলাফল সাজিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব নেই এই বঙ্গে। মানুষ কি তা চায়? চাইলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ৫ আগস্ট ঘটাল কেন?  আবু সাঈদ-মুগ্ধ-ওয়াসিমরা জীবন দিল কেন?

এই প্রজন্ম ভোট কাকে বলে দেখেইনি। পাঁচ বছরে হলেও অন্তত একবার ভোট দিয়ে পছন্দের লোককে জেতানোর গল্প শুনেছে তারা। ভোটের নামে তারা দেখেছে নাটক-সার্কাস। সেই কলঙ্ক মুছতে গেলে ইসির হাতে অনেক কাজ বাকি। মোটাদাগে নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে আছে—ছবিসহ একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়ার মতো কাজগুলো। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই শেষ করতে হয়। আর কিছু প্রস্তুতি নিতে হয় তফসিল ঘোষণার পর।

এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির বিষয়টি পুরোপুরি ইসির একার ওপর নির্ভর করে না। এখানে সরকার ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব না বুঝে সর্বোপরি দেশের জন্য একটি নির্বাচিত সরকার কত জরুরি, তা না বুঝে গড্ডলিকায় সময়ক্ষেপণের প্রবণতা বাজে বার্তা দিচ্ছে। টানা ১৭ বছর একটি দেশ বিনা ভোটে থাকা বা ভোটের নামে তামাশায় ডুবে থাকা ওই দেশটির বিশ্বদরবারে সামান্যতম গণতান্ত্রিক মর্যাদাও থাকে না। কূটনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে যায়, গেছেও। রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক গ্রাহ্যতাও নষ্ট হয়েছে। এ কারণে সদ্য শেষ হওয়া বিনিয়োগ সম্মেলনে আগতদের কেউ কেউ প্রশ্ন রেখে গেছেন সরকার ও দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে, যার সারকথা নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পান না। তা দেশি হোক আর ভিনদেশি হোক। তাঁদের পয়লা নম্বর চাওয়া নির্বাচিত স্থিতিশীল সরকার। সেটির জন্য এ সময়ের আকাঙ্ক্ষা যত দ্রুত সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে স্থিতিশীল সরকার গঠনের ম্যাপ তৈরি করা।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।