ঢাকা, রবিবার, ৫ আশ্বিন ১৪৩২, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মুক্তমত

সংস্কৃতি আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি

কাদের গনি চৌধুরী |
আপডেট: ১৫:৪৫, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫
সংস্কৃতি আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি কাদের গনি চৌধুরী

সংস্কৃতি একটি সমাজের প্রাণ। এটি মানুষের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে।

ব্যক্তিকে সামাজিক করে তালে এবং সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে। সংস্কৃতি মানুষের পরিচয় তৈরি করে, তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজবদ্ধ জীবনযাপনকে সহজ করে। সংস্কৃতি একজন ব্যক্তিকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে এবং যথার্থ সামাজিক করে তোলে। মানুষের বোধ, বুদ্ধি, বিবেক ও বিবেচনা সংস্কৃতির মাধ্যমেই গড়ে ওঠে। একটা জাতি কতটা সভ্য বা উন্নত সেটির পরিমাপ দেয় সংস্কৃতি।

সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ‘একটি সভ্যতা ধারণ করে, বয়ে নিয়ে চলে’।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলার সংস্কৃতিই আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় আমরা বাংলাদেশি।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলায় বিচিত্র মানুষ বিচিত্রভাবে বসবাস করে এটাও এ দেশের সংস্কৃতি। এখানে বাস করে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খিস্টানসহ আরও অনেক জাতি। এখানে প্রাণ খুলে তারা তাদের প্রাণের ভাষায় ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। একের অনুষ্ঠানের অন্যরা আমন্ত্রিত হয়ে, আনন্দ ভাগাভাগি করে।

আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যে উৎসব, লোকসাহিত্য, সঙ্গীত, ঋতুভিত্তিক উৎসব, ওয়াজ মাহফিল, পূজা, বিভিন্ন প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন, খেলাধুলা, সামাজিক প্রথা। পালাগান, যাত্রা গান, লোকসাহিত্য প্রভৃতি এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ের কথা বলে। একসময় কর্মক্লান্ত অবসর মুহূর্তগুলো গ্রাম্য সুরে মূর্ছনায় মুখরিত হতো। কবিগান, চম্পাবতী, লাইলী-মজনু, শিরিন-ফরহাদ, রজকীনি-চণ্ডীদাস, আলোমতি, বেদের মেয়ে জোসনা মানুষ প্রাণ ভরে দেখতো। গ্রামগঞ্জে একদিকে যেমন ওয়াজ-মাহফিল হয় আবার যাত্রাপালাও হতো, কীর্তন হতো, পূর্জা-পার্বণ হতো। কথায় আছে বাঙালির বার মাসে তের পার্বণ। সবই ছিল সৌহাদ্যপূর্ণ।

আমাদের সংস্কৃতি সকল ধর্মের মানুষের মতকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। তাই তো সকল ভেদাভেদ ভুলে ভাষার জন্য আন্দোলন করে আমরা জয়ী হয়েছি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। মনে হয় কবি এজন্যই বলেছেন—“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। ”

আগে পাড়া-মহল্লায় কিংবা বটতলায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসত বাউলদের মন মাতানো আসর। নদীমাতৃক বাংলার পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি, উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়া, পশ্চিমবঙ্গে কীর্তন ও বাউল, জারি-সারি, পল্লীগীতির আসর বসতো। আর এসব গানের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করা যেত মা, মাটি ও মানুষের গন্ধ।

মাজারগুলোকে কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিক গানের আসর বসতো। মাইজভান্ডারী গান, লালন সঙ্গীত, শাহজালালের গান আমাদের সংস্কৃতিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। এখন এসব বাউল ও ভান্ডারী গানের শিল্পীদের পাওয়া দুষ্কর। এখন বাউল গানের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিদেশি হেভি মেটাল গান। যে গানে নেই শেখার কিছু, নেই নাড়ির টান। এখন পাড়া-মহল্লায় সাউন্ড বক্সে বিদেশি গান ছাড়া কোনো আয়োজন বৃথা মনে হয়। অথচ আমাদের আছে বিশ্বমানের আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলিম কিংবা লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম, রমেশ শীলের গান। যাত্রাপালা, বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ কিংবা গানের আসর মনের খোরাক যোগাতো।

আজ বলতে দ্বিধা নেই, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে অবস্থা, তার ওপর দাঁড়িয়ে সংস্কৃতিও বদলেছে। সেই লোকনৃত্য, জারি-সারি, ভাওয়াইয়া, পালাগানের জায়গা দখল করেছে পশ্চিমা তথা ভারতীয় সংস্কৃতিচর্চা।

‘সংস্কৃতি’ রক্ষায় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু বর্তমান দুষ্টু রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি, আপসকামী রাজনীতি আমাদের গর্বিত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করছে, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন তৈরি করছে। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করছে। একে অপরকে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে। মাজারে হামলা হচ্ছে, মন্দির ভাঙা হচ্ছে। ভিন্নমতের লোকদের কবর থেকে লাশ তুলে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধ আজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন, পেশীশক্তি, ধর্মীয় উগ্রবাদ সমাজে অশান্তি তৈরি করেছে।

সাহিত্যিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন—“সাংস্কৃতিক মানে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বাঁচা। আমরা তাই সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বাঁচতে চাই। ” আমাদের মধ্যে কি সেই ধ্যানজ্ঞান আছে?

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য এখন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। যাত্রাপালা আর কবিগানের জন্য নিতে হয় অনুমতি। মাজার আমাদের সংস্কৃতির অংশ। মাজার কেবল আধ্যাত্মিক আশ্রয় নয়, বরং হয়ে উঠেছে লোকজ সংস্কৃতির উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে। সে মাজার ভাঙার যেন উৎসব চলছে। মাজার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ওলি-আউলিয়াদের শক্তি সম্পর্কে লিখেছেন—ধর্মান্ধ ও গোড়া বিজেতাদের আপ্রাণ চেষ্টা যেখানে নিতান্তই ব্যর্থ ও নিস্ফল বলে প্রমাণিত হয়েছে, মুসলিম সাধকের উদার ও শান্ত প্রবর্তনা সেখানে আশ্চর্যরূপে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। সকল স্তর ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে অবাধ মিলনের দ্বারা বিজেতা ও বিজিতের মধ্যে এই মুসলিম সাধকগণই যোগসূত্রের সৃষ্টি করেছিলেন।

পহেলা বৈশাখ আমাদের লোকায়ত উৎসব। যে উৎসবে কৃষির সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনের উপাদান পাওয়া যেত। করপোরেট আর এজেন্সিগুলো যখন বর্ষবরণ উৎসব দখল করেছে, এমনকি নৌকাবাইচও এখন করপোরেট ইভেন্ট। আগে আমরা স্কুল ডিবেটে বা বিতর্কে মাততাম ব্ল্যাকবোর্ডে ‘শহরের চেয়ে গ্রাম ভালো’ লিখে দুটো দল বানিয়ে। এখন একটা বিতর্কের আয়োজন করতে লাখ টাকা খরচ হয়। এভাবে একে একে আমাদের সব উৎসব তারা দখল করছে। আসলে আমাদের সংস্কৃতি এখন ক্ষমতাবানদের হাতে চলে গেছে। ফলে প্রাণের যোগ কমে যাচ্ছে, এখন যা হচ্ছে শুধু আনুষ্ঠানিকতা।

আমাদের জীবন থেকে সংস্কৃতি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামে গেলে যাত্রাপালা ও নাটক দেখতাম। মেলা বসতো। আমরা সবাই কত হৈচৈ করতাম। আমাদের সংস্কৃতিটা গ্রামেগঞ্জে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জীবন থেকে অনেক সৌন্দর্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন আর পাঠাগারে বই পড়তে যায় না। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন আর গান শোনে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পড়ে না। কিন্তু পড়াটা এবং শোনাটা নিজের জীবনকে সুন্দর করার জন্য খুবই জরুরি। শুধু বেঁচে থাকার জন্য তো বেঁচে থেকে লাভ নেই। জীবনটিকে সুন্দর করে বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে আনন্দময় জীবন।

গান এমন একটি শক্তি, যে শক্তি আপনার মনের জায়গাটিকে আলোকিত করে দেবে। গানের এমন শক্তি আছে, যে শক্তি দিয়ে আপনার ভোরবেলাটিকে সুন্দর করে দেবে, আপনার জীবনটিকে সুন্দর করে দেবে, আপনার বিষণ্নতাকে কাটিয়ে দেবে, আপনার অন্ধকার জীবনটিকে আলোকিত করে দেবে।

কোচিং ও স্কুল নিয়ে এখন সবাই ব্যস্ত। সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে ঐচ্ছিক, আর ওইটাই হয়ে গেছে মূল পাঠ। সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। কেউ শিল্পী হতে চায় না। সবাই বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করে। কেউ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কথা চিন্তা করে না।

শেষ করব সাহিত্যিক মোতাহার হোসেন চৌধুরীর একটা বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে। তিনি বলেছিলেন—“সংস্কৃতি মানে সুন্দর বিচিত্রভাবে বাঁচা। আমরা তাই সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বাঁচতে চাই। হিন্দু বুঝি না, মুসলিম বুঝি না, খ্রিস্টান বুঝি না, বৌদ্ধ বুঝি না, চাকমা বুঝি না, মারমা বুঝি না, আমরা বিচিত্রভাবে বাঁচতে চাই সবাইকে নিয়ে। আমাদের সংস্কৃতিই আমাদের খুলে দেবে চেতনার দরজা, সভ্যতায় সমৃদ্ধ করবে আমাদের ইতিহাস। সংস্কৃতিই হবে আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। ”

কাদের গনি চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।