ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সেলাই করা খোলা মুখ

দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া

মোফাজ্জল করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২৫
দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার—ইংরেজি নাম ইন্টেরিম গভর্নমেন্টকে অনেকে ভালোবেসে বলেন অন্তরের সরকার। এর কারণ আছে।

দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ দেশে যে অপশাসন চলেছিল, গুম-খুন-নির্যাতন-নিপীড়ন-দুর্নীতিকে পুঁজি করে তা থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই খুশি। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইও সরকার পরিবর্তনের পর হঠাৎ বেড়ে যাওয়াতে জনজীবনে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল তাও সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আগস্টের পট পরিবর্তনের পর যে অস্থিরতা ও কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, ওই বাহিনীর নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের দৃঢ়তা ও আন্তরিকতার ফলে অতি দ্রুতই তার অবসান হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে মানুষের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের সরকার নিশ্চয়ই তা অবগত আছে। আর পৃথিবীকে দারিদ্র্যমুক্ত করার স্বপ্নদ্রষ্টা প্রফেসর মহোদয় এও খুব ভালো করেই জানেন তাঁর দেশের শতকরা ২০-২৫ জন মানুষের চোখের ঘুম কেড়ে নেওয়ার আরেক উপসর্গ হচ্ছে ক্ষুধা।

এটা যে কত বড় শত্রু তা আমাদের মতো বৈশাখ মাসের গরমে এয়ারকুলার, নিদেনপক্ষে বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়ার ভেতর সুখনিদ্রা যাওয়া সৌভাগ্যবানরা জানার কথা না। কিন্তু একবার চোখ বুজে ভেবে দেখুন, এই প্রায় দেড় কোটি পৌনে দুই কোটি, কেউ কেউ মনে করেন পুরো দুই কোটি, মানুষের ঢাকা শহরে আজ রাতে পেটে ক্ষুধার দাবদাহের কাতরতা নিয়ে ছটফট করতে থাকা কত বস্তিবাসী, কত ফুটপাতবাসী মানুষ ও তাদের শিশুসন্তানরা সামান্য একটু অন্ন-ব্যঞ্জনের অভাবে নিজের অদৃষ্টকে দোষারোপ করতে করতে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে। আর তাও এক দিন নয়, দুই দিন নয়, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।

পত্রপত্রিকায় যখন দ্রব্যমূল্য নিয়ে লেখালেখি হয়, সভা-সমিতি-সেমিনারে অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা ঝাড়েন তুখোড় বক্তারা, তখন আমার একটা কথাই কেন জানি মনে হয় : চালের কেজি ৫০ টাকাই হোক আর ৫০০ টাকাই হোক, এক শ্রেণির মানুষের তাতে কিচ্ছুটি যায় আসে না।

তাঁরা আগে যেমন চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে রসনা পরিতৃপ্ত করতেন, এখনো তাই করবেন। এবং ভবিষ্যতেও। হ্যাঁ, তাঁদের সংখ্যা কম। হয়তো মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই-তিনজন তাঁরা। কিন্তু তাঁরাই এই ১৭ কোটির ভাগ্যবিধাতা।

দেশের কোটি কোটি দরিদ্র কৃষিজীবী গ্রামবাসী, যাদের একটি বড় অংশই ভূমিহীন, শহরের বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষ, যারা এক বেলা দুমুঠো গিলতে পারলে এক হাজারবার আল্লাহর শুকুর গোজার করে, হা-পিত্যেশ করে পরের বেলা কী জুটবে তার জন্য। তারা কারো কাছে চাকরি চায় না, গাড়ি চায় না, বাড়ি চায় না, পূর্বাচলের প্লট চায় না, তারা চায় শুধু দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান। তারা তাই বাজারে চালের কেজি ৫০ টাকা থেকে ৫২ টাকা হলে, শাকের আঁটি ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা হলে, ভোজ্যতেলের দাম ১০ টাকা বেড়ে গেলে চোখে অন্ধকার দেখে। তাদের কাছে চাল-ডাল-মাছ-তরকারি-তেল-নুন-পেঁয়াজই হচ্ছে জীবনের মোক্ষ। অথচ এগুলো কিছুরই নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নয়।

সাধারণ মানুষের ধারণা, ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সরকার ইচ্ছা করলেই করতে পারে। এ রকম ধারণা যে খুব একটা অমূলক তা নয়। সরকার যে প্রশাসনযন্ত্র দ্বারা মজুদদারি, কালোবাজারি, চোরাচালান ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করল, সেই একই প্রশাসনকে দ্রব্যমূল্যের অন্যায্য উল্লম্ফন রোধ করার কাজেও লাগাতে পারে। মাঝে মাঝে যে লাগান না এমন নয়। বাজার মনিটরিং, মজুদদারি দমন ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয় বটে, তবে এগুলো যেন কেমন নিষ্প্রাণ, পানসে, কেমন লোক-দেখানো মনে হয়।

এ প্রসঙ্গে তথাকথিত ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ে দুটো কথা বলা দরকার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মজুদদারি, কালোবাজারি ইত্যাদি নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশ আমল—সব আমলেই এসব উপদ্রব কমবেশি ছিল। স্বাধীনতার পর তিনটি বৃহত্তর জেলায় (কুষ্টিয়া, খুলনা, ঢাকা) জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দুই দশক আগেও অপরাধজগতে এই সিন্ডিকেট নামক পর্দার অন্তরালের কুলীন অপরাধীদের নামও শোনা যায়নি। আজকাল সরকার-‘বেসরকার’ সবাই এই গোপন ঘাতকদের কথা বলে। কিন্তু না কেউ তাদের পরিচয় জনসমক্ষে তুলে ধরে, না তাদের পাকড়াও করে। ‘কেইসটা’ কী? সিন্ডিকেটই যদি তেল-পেঁয়াজ-আদা-রসুন-চিনি-চালের মূল্যের অন্যায্য ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী হয় তাহলে তাদের পাকড়াও করতে বাধা কোথায়? কদিন আগেও না হয় তাদের মুরব্বি ছিল, পার্টনার ছিল বুঝলাম, যাদের কারণে প্রশাসনের লোকজনের হাত-পা ছিল বাঁধা, কিন্তু এখন? এখন তো তাদের ধরে আইনের আওতায় আনতে কোনো বাধা নেই। তাহলে গত আট মাসে আটজন রুই-কাতলাকে ধরে ‘সিন্ডিকেট’ নামক ‘মিথ’ ভেঙে দেওয়া হলো না কেন? কর্তাব্যক্তিরা জবাব দেবেন কি? নাকি দুষ্ট লোকে যে বলে ফ্যাসিস্টের আণ্ডা-গণ্ডা এখনো সবখানে ঘাপটি মেরে আছে বেচারা নোবেল বিজয়ীকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার জন্য, তাই সত্যি? আমাদের বিনীত আরজ (দাবি বলব না, কারণ আজকাল দেখা যাচ্ছে, দাবি আদায়ের নাম করে ছাত্র-অছাত্র অনেকেই শাহবাগের মোড়, সচিবালয়ের গেট ও প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনের আশপাশে সময়ে-অসময়ে ভিড় করে জনদুর্ভোগের কারণ হচ্ছে), দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন অযৌক্তিক ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী তথাকথিত সিন্ডিকেটের মুখোশ উন্মোচন করুন, পত্রপত্রিকায় তাদের পরিচয় তুলে ধরুন এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিন। যত শক্তিশালীই হোক না কেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা তো ভাশুর না যে তাদের নাম মুখে আনা যাবে না, তাদের স্পর্শ করলে জাত যাবে।

সেই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির প্রকৃত কারণগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ডিমান্ড ও সাপ্লাইয়ের (চাহিদা ও সরবরাহের) মৌলিক ধারণাগুলো মাথায় রেখে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ফাঁকফোকর চিহ্নিত করে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ কৃষিজাত পণ্যের কথা বলা যায়। আমাদের এই কৃষিনির্ভর দেশে কাঁচাবাজারের প্রায় সব পণ্যই (যেমন শাক-সবজি, মাছ-মাংস) উৎপন্ন হয় গ্রামাঞ্চলে। আর শুধু আমাদের দেশই বলি কেন, পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত, ধনী-গরিব, ছোট-বড় সব দেশেই গ্রামই হচ্ছে খাদ্যের জোগানদার। তবে আমাদের মতো গরিব, স্বল্পোন্নত দেশের সঙ্গে উন্নত দেশের তফাত হচ্ছে ওরা কৃষিকাজকে—তা শস্য উৎপাদনই হোক আর গবাদি পশু পালনই হোক—সম্মানের চোখে দেখে, আর আমরা কৃষিজীবীকে ‘মূর্খ, চাষা’ বলে গালি দিয়ে সম্বোধন করে থাকি। কৃষক তার উৎপন্ন পণ্যের ন্যায্যমূল্য যাতে পায় সেদিকে উন্নত বিশ্বের সরকারের সতর্ক দৃষ্টি থাকে সব সময়।

আমরা উঠতে-বসতে সব সময় বাজারে চাল-ডাল-তরি-তরকারির উচ্চমূল্যের কথা বলি। অথচ এই মূল্য যে পণ্যের উৎপাদনকারীর হাতে পৌঁছে না সে কথাটি কখনো ভেবে দেখি না। যে লাউটি আপনি ৫০ টাকা দিয়ে ঢাকার বাজারে সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে কিনলেন, আপনি জানেন কি সেই লাউটির উৎপাদনকারী কৃষক ৫০ মাইল দূরের শিবপুর বা মনোহরদীতে মাত্র ১২ বা ১৪ টাকায় বিক্রি করেছে একজন পাইকারের কাছে। পাইকার ব্যাংকের ঋণের টাকা জেবে পুরে শহর থেকে বাইকে চড়ে চলে গেছে ওই কৃষকের কাছে (কিংবা দুই মাস আগে কৃষককে ৫০০ টাকা দাদন দিয়েছে লাউ ফলানোর জন্য)। তারপর পাইকার ওই লাউ ও তার সঙ্গে আরো পাঁচ-সাত রকমের তরকারি কিনে তা পৌঁছে দেবে আরেকজনের কাছে, এই ব্যবসায়ে যার পুঁজির বিনিয়োগ আরো বেশি। এভাবে দু-তিন হাত বদল হয়ে ঢাকার কারওয়ান বাজার-ঠাটারীবাজার-মৌলভীবাজারে যখন লাউটি পৌঁছে তখন তার দাম ৩০-৩৫ টাকায় পৌঁছে। এমনি করে উৎপাদনকারী ও প্রকৃত ভোক্তার মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী কয়েক ব্যক্তি কেবল টাকার জোরে (সেই টাকাও কোনো সরকারি/বেসরকারি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা) ১২ টাকার লাউয়ের মূল্য ৪০-৫০ টাকায় ওঠায়, যে টাকা যায় ভোক্তার পকেট থেকে।

এই মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে উৎপাদনকারী না পাচ্ছে উচিত মূল্য, না ভোক্তা পণ্যটি কিনতে পারছে ন্যায্যমূল্যে।

সদাশয় অন্তরের সরকার, থুড়ি অন্তর্বর্তী সরকার, বিষয়টি একটু ভেবে দেখবেন কি? জানি আপনারা ব্যস্ত বড় বড় সংস্কার নিয়ে। তবে এই কৃষিপণ্যের বাজারের দিকে একটু মনোযোগ দিলে মানুষ তাদের অন্তরে স্থান দেবে আপনাদের, চিরকাল স্মরণ করবে আপনাদের যুগান্তকারী পদক্ষেপকে। কাজে লাগান না কেন আপনাদের কৃষি বিপণন বিভাগ, সমবায় বিভাগ প্রভৃতিকে। আমি নিশ্চিত, আপনারা দোয়া পাবেন লাখ লাখ চাষি ও কোটি কোটি ভোক্তার।

লেখক: সাবেক সচিব, কবি
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২৫
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।