রাজনীতিতে স্বস্তির অপ্রতুলতা, অর্থনীতিতে ধারাবাহিক নাজুকতা এবং সমাজ ব্যবস্থায় খণ্ড খণ্ড অসহিষ্ণুতার পরও মোটামুটি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশ। ফ্যাসিস্ট শাসনামলের ছায়া-উপছায়াকে সঙ্গী করেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মতো বড় চ্যালেঞ্জ অনেকটাই সামলে উঠতে পেরেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হতে যাচ্ছে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ইস্যুতে কক্সবাজারে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি ঘিরে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু নির্বাচনে জয় নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় সঠিক নেতৃত্ব বাছাই হবে আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সততা বা দৃষ্টিভঙ্গি এখানে যথেষ্ট নয়; বরং মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ‘যোগ্যতাভিত্তিক বাছাই’ বা ‘হ্যান্ড সিলেকশন’ রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় শীর্ষ থেকে শুরু করে প্রতিটি দায়িত্বশীল কর্মকর্তার যোগ্যতা, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ রাষ্ট্র পরিচালনায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করণে অপরিহার্য। শুধু মন্ত্রী বা সচিবের জন্য নয়, তাদের আশেপাশের সহকারী ও কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা বলছে, আমাদের রাষ্ট্রের নানা স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক বাছাই অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়েছে। দলীয় আনুগত্য, পারিবারিক অর্থবিত্ত ও প্রভাবের ভিত্তিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য ও অসৎ মানুষদের বসানো হয়েছিল; যারা লুটপাট করে কেবল নিজ ও আশপাশের লোকজনের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তা নয়; পেশাগত নৈতিকতা ধ্বংস করেছেন এবং অন্যদের একই পথে চলতে উৎসাহিত করেছেন। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি স্তরে নৈতিকতার ঘাটতি, সীমাহীন দুর্নীতি এবং জবাবদিহিতাহীন সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা যদি জনগণের ভোটে বিজয় হওয়া নতুন সরকারের ক্ষেত্রে অব্যাহত থাকে; তাহলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন তো দূরের কথা; জুলাই আন্দোলনের ত্যাগ; বিশেষ করে সেই ২০১৪ সাল থেকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে টানা লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস হারাবে তার অর্থবহতা।
রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য, সৎ ও মেধাবী মানুষকে দায়িত্বে আনা শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের টিকে থাকা ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য শর্ত। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার Republic গ্রন্থে বলেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু জ্ঞানী নয়, নৈতিক দিক থেকে দৃঢ় ব্যক্তির হাতে থাকা উচিত। এখানে নৈতিকতা ও দক্ষতা দুটোই অপরিহার্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্লেটো। সহজ কথা হলো, মানুষ হচ্ছে মূল সম্পদ। ভুল মানুষ বাছাই করলে পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। ভুল সহচর বেছে নেওয়া হলে সৎ উদ্দেশ্যও ভুল পথে ধাবিত হয়। কেননা জনগণ সাধারণত শীর্ষ নেতৃত্ব নয়, বরং মধ্য পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গেই বেশি যোগাযোগ করে।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বিশ্বের এমন একাধিক রাষ্ট্র রয়েছে যেখানে সরকার প্রধান সৎ ও যোগ্য মানুষ বাছাই করে যথাযথ দায়িত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে সফল হয়েছেন। যেমন সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৬৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন লি কুয়ান ইউ। তিনি সতর্কভাবে নিজ দলে, মন্ত্রিসভা ও প্রশাসনে দক্ষ ও নৈতিক নেতৃত্ব বেছে নেন। এতে করে অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন, বিশ্বমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তেমনি চীনা রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবী ডেং শিয়াওপিং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং চীনের আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আশির দশকে চীনকে বেসরকারিকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগের দিকে পরিচালিত করেন। প্রসঙ্গক্রমে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের কথা না বললে নয়। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত দাস প্রথার বিলোপ নিয়ে মার্কিন গৃহযুদ্ধ এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে। তিনি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে উইলিয়াম সিওয়ার্ড ও এডউইন স্ট্যানটনকে মন্ত্রিসভায় নিয়োগ দেন। কারণ তিনি দক্ষতা ও সততাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের ভয়াবহ গণহত্যার পর রুয়ান্ডা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিভক্ত। প্রেসিডেন্ট পল কাগামে দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে শিক্ষিত, তরুণ ও সৎ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আনেন, যেমন ডোনাল্ড কাবেরুকা। পরে তিনি আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, তুরস্কের মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক, ফ্রান্সের শার্ল দ্য গোল, আমেরিকার ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ও বিশ্বে শান্তি ও অহিংস সংগ্রামের প্রতীক ভারতের মহাত্মা গান্ধীর নাম উল্লেখ করা যায়; যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এবং তারা সকলে অত্যন্ত জটিল, যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও অশান্তিময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
আসন্ন নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসুক না কেন; উন্নত নীতিনির্ধারণ ও কার্যকর পরিকল্পনার পাশাপাশি যোগ্য, সৎ ও নৈতিকভাবে দৃঢ় ব্যক্তিদের হাতে দায়িত্ব বণ্টনে যদি ভুল করেন, বিতর্কের জন্ম দেন, জনগণের নিরাপত্তা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ব্যর্থ হন, মৌলিক চাহিদা যদি পূরণ না হয়, উন্নয়নের নামে সেই আগের মতো লুটপাট বিশেষ করে সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি যদি চলতে থাকে; সে যত বড় রাজনৈতিক দলের সরকার হোক না কেন; পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা তো দূরের কথা; বরং চিরকালের জন্য প্রত্যাখ্যাত হবে। কেননা জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে পুরো জাতি কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
সুজায়েত শামীম সুমন: অপরাধ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এমজেএফ