ঢাকা, রবিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩২, ০৪ মে ২০২৫, ০৬ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

সপরিবার অ্যাকাউন্ট জব্দে ব্যবসায়ীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়

মোস্তফা কামাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০৪, মে ৪, ২০২৫
সপরিবার অ্যাকাউন্ট জব্দে ব্যবসায়ীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোস্তফা কামাল

ব্যাংক হিসাব জব্দের নমুনায় শেখ হাসিনার পিয়ন জাহাঙ্গীর-কামরুন্নাহার দম্পতির লেভেলে নামিয়ে আনার কুপ্রবণতার শিকার কয়েকজন ব্যবসায়ী। ব্যবসা-বিনিয়োগ, নিয়োগ তথা কর্মসংস্থান তৈরি করে দেশের অর্থনীতির শিরায় রক্তসঞ্চালনকারীদের একদিকে সোহাগ করে বলা হচ্ছে ‘রিয়েল হিরো’, অন্যদিকে হিরোদের বানানো হচ্ছে ভিলেন।

বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতির ধমনিতে নাড়া দেওয়ার আহ্বানের সমান্তরালে আরোপ হচ্ছে বিনিয়োগবিরোধী অ্যাকশন। সাংঘর্ষিক বা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের শিকার ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা এতে হতবাক। না পারছেন চিৎকার করে কাঁদতে, না পারছেন অবিরাম সইতে। তাই বোবাকান্নাই নিয়তি! তাদের ওপর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভীতিকর নানান কাণ্ডকীর্তিতে চলল এক ফের। এর পরও হাল না ছেড়ে টিকে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালানো ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের আরেক ফের। এমনিতেই মামলা-হামলাসহ নানান ঘটনায় দেশের বেশ কিছু শিল্প গ্রুপের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন কারখানায় পরিকল্পিতভাবে ভাঙচুর, বিক্ষোভ ও হামলা চালিয়েছে চক্রবিশেষ। তার ওপর ব্যবসায়ীদের নামে পাইকারি মামলাবাজি। এসবের তোড়ে বহু কারখানা বন্ধ। কর্মহীন হাজারো শ্রমিক-কর্মচারী। সরকারের বিভিন্ন কর্নার থেকে শক্ত হওয়ার আশ্বাস মিলেছে। এসব আর হবে না, এমন ভরসা মেলায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা দেয়। নতুন করে হামলা, লুট, মামলার তেজও কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু দম না ফেলতেই গজবের মতো নামে পরিবারসহ ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের আজাব।

তা প্রকারান্তরে কেবল সেরের ওপর সোয়া সেরই নয়, ঢোলের বাদ্যের মতো পরিবারের সদস্যসহ ব্যবসায়ীদের মানইজ্জতের সর্বনাশ করে দেওয়া। যেন সমাজে তাঁদের মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা। ব্যবসায়ীদের কাছে বিষয়টি অর্থনৈতিকভাবে হয়রানিমূলক, সামাজিকভাবে চরম নিপীড়নমূলক। হিংসাত্মকও। লাজশরমে ব্যবসাবাণিজ্য গুটিয়ে কোনো কোনো ব্যবসায়ী না পারতে প্রকাশ্যে বেরও হন না। নতুন বিনিয়োগ দূরে থাক, এতদিনে করা বিনিয়োগ রক্ষা নিয়েও পেরেশানিতে অনেকে। লজ্জাশরমে তা প্রকাশও করতে পারছেন না।

বিনিয়োগ ও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি না বাড়লে অর্থনীতির সম্প্রসারণ হয় না, তা বুঝতে ঝানু অর্থনীতিবিদ হওয়া জরুরি নয়। সাধারণ কাণ্ড জ্ঞানের যে কোনো মানুষেরই তা বোধগম্য। তারা এর বিপরীত বাস্তবতা দেখছেন। ব্যবসা-বিনিয়োগে সহায়ক নীতিমালা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় সংস্কার আবশ্যক হলেও এর নমুনা নেই। দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় গলদ অনেক দিনের। তার ওপর অবিরাম প্রতিবন্ধকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ছোটবড় সব ব্যবসা-বিনিয়োগেই বড় বাধা। কেউ কেউ দলবাজিতে জড়িয়ে বিনা বিনিয়োগে টাকা হাতিয়েছেন। বাকিরা বিশাল পুঁজি খাটিয়ে অনেকের কর্মসংস্থান করেও টিকে থাকার চেষ্টায় কুলাতে পারেননি। যার জেরে দেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই মন্দা। ব্যবসা-বিনিয়োগে ভর করছে সংকটের পর সংকট। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একদিকে যেমন বেশ কিছু শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে, আবার সম্ভাবনাময় অনেক শিল্পকারখানাও অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অর্থায়নসংকট, ঋণসহায়তা, সুদহার বৃদ্ধিও ব্যবসায়ীদের অনেকের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।

বিশ্বের কোনো বিনিয়োগকারীই এমন অনিশ্চয়তায় থাকতে চান না। তার ওপর অসম্মানিত হতে থাকা দুর্ভাবনার। বিনিয়োগ না থাকলে নিয়োগ বা কর্মসংস্থান আসে না। পরিস্থিতির বাস্তবতা ও নানান সীমাবদ্ধতায় ব্যবসায়ীরা তা সরাসরি বলতে পারছেন না। কোনো কোনো ব্যবসায়ী তো সভা-সেমিনারও এড়িয়ে চলেন। কী বলে কোন ঝামেলায় পড়েন, কোন ট্যাগের শিকার হন সেই ভয়ের তাড়নায় তারা। যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একটা দেশে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার হয়, বিনিয়োগ বাড়ে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সেটা নেই-এ কথা স্পষ্ট করে বলার অবস্থা অনেক ব্যবসায়ীরই নেই। বিদেশি ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক সাহসী। সীমাবদ্ধতা কম, বেশ চালাকও তারা। যে কারণে আলোচিত বিনিয়োগ সম্মেলনে আসা বিদেশি ব্যবসায়ীরা বারবার বিনিয়োগের পরিবেশের কথা বলেছেন। পুঁজির গ্যারান্টি চেয়েছেন। বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা দেখেছেন। কিন্তু খাসকথা দেননি।

দেশি ব্যবসায়ীদেরও তা মনের কথা। কিন্তু মনের কথা মুখে এনে আরও কোনো দুর্গতিতে পড়েন, এ ভয়ে তাদের মুখ বন্ধ। দেশের শিল্পাঞ্চলে কেন ভয়াবহ সংকট চলছে? চট্টগ্রাম ও ঢাকা ঘিরে গড়ে ওঠা ইস্পাত, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, সিরামিক খাত কী কারণে অস্তিত্বসংকটে ভুগছে? তারা এর ভিতরটা জানলেও বলেন না। গত সাত-আট মাসে গ্যাস-বিদ্যুৎসংকট ও লাগামহীন দাম বৃদ্ধির ফলে অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কর্মহারা হয়েছেন অনেকে। আর বিনিয়োগের অপেক্ষায় থাকা শতাধিক প্রকল্প থমকে গেছে। দেশি ব্যবসায়ীরা গলা খুলে বলছেন না বলে এ তথ্য বিদেশিদের অজানা থাকছে না। তারাও জানেন, ২০২৩ সালে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ১৭৮% এবং চলতি এপ্রিলে নতুন করে ৩৩% বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের দামও গত ১৪ বছরে বেড়েছে নয়বার। অথচ গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাজানো অভিযোগের ভলিউম বেশ মোটা। মানি লন্ডারিং, রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি দখল, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জন-কী নেই অভিযোগনামায়? নানান অভিযোগের ঢালাও প্রচারে বিচারের আগেই বিচার। সাজাও দিয়ে ফেলা হচ্ছে। পারলে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে নাতিপুতিদেরও চরিত্রহননের কাজটি করে দেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকলে কেবল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নয়, আরও অনেক কিছুই জব্দ করা যায়। শক্ত বিচারের আওতায় নেওয়াও জরুরি। কিন্তু সে পথ না মাড়িয়ে মব সন্ত্রাসের মতো একতরফা ট্রায়ালে একদিকে বিনিয়োগকে মাঠে মারা, আরেকদিকে সামাজিক মানসম্মানও খেয়ে ফেলা হচ্ছে। এর অনিবার্য জেরে প্রায়ই ছোটবড় কোনো না কোনো কলকারখানা, প্রতিষ্ঠান বন্ধের কুখবর। ছোটখাটো খবরগুলো গণমাধ্যমে আসে না। বেকারত্বের বোঝা বৃদ্ধির বিষয়টি তাৎক্ষণিক বিবেচনায়ও আসে না। এমনিতেই দেশময় বেকারের কিলবিল। বেশুমার বেকারের সংখ্যা। তার ওপর মাস কয়েক ধরে নতুন বেকার পয়দা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৪০ হাজারে। বাস্তব সংখ্যাটি আরও বেশি, হিসাব ছাড়া। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের হিসাবে দেশে প্রচ্ছন্ন বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি। বেকারের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা ঠিক না হওয়ায় বেকারত্বের প্রকৃত জরিপ বা হিসাব বের করা সম্ভব নয়। দেশে বেকার-নিরাকার নিয়ে খটকা আছে। বিবেচনার ফের আছে। শিক্ষা শেষে চাকরি না পেয়ে টিউশন করা বা কোনো প্রশিক্ষণ নিয়ে সেই দৃষ্টে কাজ না পেয়ে শীতে সেদ্ধ ডিম বা গরমে ডাব বিক্রি করা ব্যক্তিদের বেকার ধরা হয় না।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ শেষের সাত দিনে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ না পেলেই কেবল বেকার ধরা হয়। বিবিএসও এ সংজ্ঞা ব্যবহার করে। সে হিসেবে দেশে বেকার নেই বলার মতো অবস্থা। এ বেশুমার বেকারের বেশির ভাগের কর্মসংস্থান হয় বেসরকারি সেক্টরে। বিবিএসের হিসাবে দেশে মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরির অংশীদারি মাত্র ৩.৮ শতাংশ। বেসরকারিতে কর্মসংস্থান হয় ১৪.২ শতাংশ। প্রায় ৬১ শতাংশের কর্মসংস্থান হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে। বাকি ২১ শতাংশ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত। রাজনৈতিক ঘনঘটায় একে একে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় বেকারত্বের ঢোলে বাড়ি পড়েছে গজবের মতো। সরকার পরিবর্তনের পর এ বাড়ির বাদ্য গত কয়েক মাসে তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি খাতে কী যন্ত্রণা তৈরি করেছে, তা সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিক দুই ভুক্তভোগী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন। অন্য কারও কারও পক্ষে ধারণারও বাইরে শ্রমিক-মালিক উভয়ই কী যাতনায় ভুগছেন, তা উপলব্ধি করা। চাকরিহারাদের কান্না-আহাজারির সুযোগ আছে। তা শোনার বড় জায়গা নিয়োগকর্তারাই বোবাকান্নায় কাতরালে কর্মহারাদের খবর কে নেবে? সিমেন্ট ঢালাইয়ের মতো তাদের যেভাবে ঢালাও ঢালাই করে ফেলা হচ্ছে, সেখানে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ-নিয়োগের ভরসা কোথায়?

সামনে আরও কী অপেক্ষা করছে, মালিকদের ভাবনায় অকুলান। কারখানা চালু রাখা, অর্ডার নেওয়া, কাঁচামাল কেনা, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল নিয়ে অন্ধকার দেখছেন তাঁরা। এখনো বেকার না হওয়া শ্রমিকরা আতঙ্কে। আর এরই মধ্যে বেকার হয়ে যাওয়াদের বাসাভাড়া দেওয়ার অবস্থা নেই। হাটবাজার বন্ধ। এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে। লোকালয়েও পড়তে শুরু করেছে। বেকার বলে তারা ঘরে বসেও থাকছেন না। চলে যাচ্ছেন কলকারখানার কাছাকাছি সহকর্মীদের কাছে বুদ্ধি-পরামর্শ-সহযোগিতা নিতে। সহযোগিতা না মিললেও উসকানি মিলছে সেখানে, যার জেরে সমাজে অস্থিরতায় টোকা পড়ছে। ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। তারা সামাজিক স্থিতিশীলতাকে কোথায় নেবেন, এ প্রশ্নও অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। ওয়ান-ইলেভেন সরকারও নিয়োগকর্তাদের কাঁদিয়েছে, ভুগিয়েছে।

নানান বদনামে কলঙ্কিত করেছে। সেই ঘায়ের মাঝেও তারা যদ্দুর পেরেছে, টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। গেল সরকারের শেষ কয়েক বছর ব্যবসায়ীরা জ্বলেছেন আরেক উনুনে। জোরজবরদস্তিতে নাকে খত দেওয়ানোর মতো তাদের গায়ে ট্যাগ লাগানো হয়েছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে যোগ হয়েছে আরেক ভোগান্তি। একটি অরাজনৈতিক সরকার আসার পর তাদের অপেক্ষা ছিল দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সাবলীল পরিবেশের। সেখানে কেবল আশাভঙ্গ নয়, উপরির মতো যোগ হয়েছে বাড়তি ভোগান্তি। আর বোনাস হিসেবে চরিত্রহনন, গোষ্ঠীসুদ্ধ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের খড়্গ। সামগ্রিকভাবে এটি মোটেই সুস্থতা নয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।