ধর্মের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্কটা কি পিতার সঙ্গে পুত্রের সম্পর্ক? হ্যাঁ, অনেকটা তা-ই। তবে অবশ্যই যোগ করতে হবে যে সাম্প্রদায়িকতা ধর্মের নষ্টপুত্র।
রাষ্ট্রও বিভাজন পছন্দ করে। করে এজন্য যে রাষ্ট্র স্বার্থ দেখে একাংশের, অপরাংশের নয়। কতকাল আগে আদর্শ রাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছিলেন প্লেটো। সেই পরিকল্পনায় শ্রেণিতে শ্রেণিতে পরিষ্কার বিভাজন ছিল। শ্রমিকেরা উৎপাদন করবে, সৈনিকরা দেশ রক্ষা করবে, আর দার্শনিকরা করবেন দেশ শাসন। নিচের লোক ওপরে উঠতে পারবে না। কখনো নয়। এরকম একটা ব্যবস্থা কল্পনা করা সহজ ঠিকই, কিন্তু বাস্তবায়িত করা খুবই কঠিন। কেননা নিচের লোকেরা সব সময় মেনে নেয় না। অনেক সময়েই বিদ্রোহ করে। তখন দরকার পড়ে সেনাবাহিনীর। বস্তুত সেনাবাহিনী দেশ রক্ষা যতটা না করে, তার চেয়ে অনেক বেশি করে শাসকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষা।
ভারতের প্রাচীন শাসকেরা তাই একটি কাজ করলেন খুব ভালোভা্েব তাঁদের দিক থেকে। শ্রেণিবিভাজনটাকে চিরস্থায়ী করে নিলেন, সঙ্গে ধর্মকে যোগ করে দিয়ে। তাঁরা বলিয়ে নিলেন যে সবকিছুই পূর্বজন্মের কর্মফল। তুমি যে শূদ্র হয়েছ, তার কারণ পূর্বজন্মে তুমি পাপ করেছিলে। আর আমি যে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছি, তার কারণ এই যে পূর্বজন্মে আমি পুণ্য করেছিলাম। নিশ্চয়ই করেছিলাম, নইলে ব্রাহ্মণ হলাম কী করে? এরকমের যুক্তি যখন দাঁড় করানো যায়, তখন আর সিপাহি-সান্ত্রীর আবশ্যকতা থাকে না, মানুষ আপনা থেকেই শ্রেণিবিভাজনটা মেনে নেয়। প্রতিবাদ করে না। অগোছালো রাষ্ট্র গোছালোভাবে শ্রেণিবিভাজনকে সাজিয়ে নিয়েছে।
ধর্মকে এভাবে শ্রেণিবিভাজনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারার পেছনে একটা বড় উপাদান ছিল এই যে এ উপমহাদেশে ধর্মের জন্য ক্ষেত্র বেশ প্রশস্ত ও উর্বর ছিল। খুব বেশি কিছু না করেও বস্তুগত সিদ্ধি লাভের সুযোগ মানুষকে উৎসাহিত করেছে আধ্যাত্মিক, অতীন্দ্রিয়বাদী ইত্যাদি হতে। ‘রীজনে’র জন্য যে শ্রম করা আবশ্যক সেটা না করে লোকে ‘রিভিলেশনে’র ওপর আস্থা রাখাটা পছন্দ করেছে। জ্ঞান অতীন্দ্রিয়লোক থেকে টুপ করে পড়েছে, ইন্দ্রিয়লোকে তাকে অর্জন করতে হয়নি, যুক্তি ও পরিশ্রমের সাহায্যে।
শাসকেরা তাই ধর্মকে সহজেই পেয়ে গেছেন, ব্যবহারের অস্ত্র হিসেবে। আর্যরা পেয়েছে, মোগলরাও পেয়েছে। ধর্মের ব্যাপারে উদার যে আকবর বাদশাহ, তিনিও যে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন তা বলা যাবে না। তিনিও ‘দ্বীন-এ-এলাহি’ নামে একটি নতুন ধর্মমত চালু করতে চেয়েছিলেন সর্বধর্মের সমন্বয় ঘটিয়ে। পরবর্তীকালে আমাদের এই বাংলাদেশেও দেখেছি, ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ইহজাগতিকতা না বুঝিয়ে আরও বেশি করে, স্বাধীনভাবে, ধর্ম চর্চাকেই বোঝানো হয়েছে। ইহজাগতিকতাকে পুষ্ট করেনি, ধর্মবাদিকতাকেই বরং পুষ্ট করেছে। প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পরস্পর থেকে আলাদা করে ফেলা, আর এখানেই থাকে ইহজাগতিকতার পক্ষে প্রসারের একটি চমৎকার সুযোগ ধর্মনিরপেক্ষতা।
উপমহাদেশে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করা সহজ হয়নি। প্রাক-ইংরেজ যুগে সমাজে একধরনের স্থবিরতা ছিল। তবু তার ভিতরও পুঁজিবাদী বিকাশের একটি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল বৈকি। ইংরেজ আগমনে সেটা গেল নষ্ট হয়ে। স্থবিরতা ধর্মের আধিপত্য বিস্তারের পক্ষে সহায়ক, সব সময়ই। ওদিকে পুঁজিবাদী ইংরেজ ভারতবর্ষে এসে সামন্তবাদী মানসিকতাকে উৎসাহিত করতে থাকল। সেটা আরেক দিক। অন্য এবং আরও গভীর দিকটি হলো, পরাধীনতা। মানুষের স্বাধীন বিকাশের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াল এই বৈদেশিক শাসন। পরনির্ভরতা, অদৃষ্টবাদ এবং সর্বোপরি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটল এবং ঘটতে থাকল কিছুটা প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে আরও বেশি। ইংরেজ অবশ্য তার ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। সাম্রাজ্যবাদের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে মিশনারিরা কাজ করবে ভেবেছিল, কিন্তু ১৮৫৭-এর সিপাহি অভ্যুত্থানের পর থেকে ইংরেজ বুঝে নিল যে ধর্মের ব্যাপারে হাত দেওয়া বিপজ্জনক হবে। তার চেয়ে ভালো দেশি মানুষদের ধর্মবোধকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে উৎসাহিত করা। সেজন্য তারা প্রাচ্যবিদ্যার প্রসার চাইল। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে উৎসাহিত করল। পুঁজিবাদের স্বাধীন বিকাশের পথ অবরুদ্ধ করে দিয়েই অবশ্য ভারতবর্ষের জন্য সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছিল দীর্ঘস্থায়ী ইংরেজ শাসন। ওই অবরোধের উল্টো পিঠে শক্তিশালী হচ্ছিল সামন্তবাদ।
রাজনীতিতেও তার প্রবেশ ঘটেছে বৈকি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা সামন্তবাদ বিরোধিতার দায়িত্ব পালন করেনি। বরং দেখা গেছে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে লড়াইটা নিজেই সামন্তবাদী চরিত্র ধারণ করেছে। দেশকে মাতার মতো ‘পূজা’ করা, ধর্মবাদী আন্দোলনে মা-কালীকে অনুপ্রেরণাদায়িনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, এসব ঘটনা সামন্তবাদের প্রতি আনুগত্যের লক্ষণ বটে। এটা ঠিক যে সে মুহূর্তে প্রধান দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই ছিল, সামন্তবাদের সঙ্গে নয়। কিন্তু ওটা আরও বেশি ঠিক যে সামন্তবাদবিরোধিতা পরিহার করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম শক্তিশালী করা যায়। আর যদি সাম্রাজ্যবাদকে একমাত্র শত্রু মনে করে সামন্তবাদকে মিত্র জ্ঞান করা হয় তাহলে সামনে এগোনোর কোনো উপায়ই থাকে না, এগোতে গিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়। ইংরেজ আমলে, বলা বাহুল্য, ওই ঘটনাই ঘটেছে। প্রবল ইংরেজবিরোধিতার অন্তরালে ধর্মীয় চেতনা শক্তিশালী হয়েছে। যে বুর্জোয়ারা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছিলেন, তারা নিজেরা স্বাধীন ছিলেন না। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার প্রশ্নটা তো ওঠেই না, সাংস্কৃতিকভাবেও স্বাধীন ছিলেন না। তাঁরা আবদ্ধ ছিলেন সামন্তবাদী চিন্তা-চেতনায়। আরও যে ক্ষতির ঘটনা ঘটল সেটা হলো সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি। উপমহাদেশের কৃষক নানা ঐতিহাসিক কারণে ধর্মভীরু ছিল বটে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ছিল না। বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোতে ধর্মীয় সহনশীলতা অত্যন্ত স্পষ্ট রূপেই লক্ষণীয় ছিল। স্বাধীনতার যে লড়াইতে হিন্দু-মুসলিমের একত্রে লড়ার কথা, সেখানে তা ঘটল না। সামন্তবাদী ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বক্তব্য এসে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথমে বিচ্ছিন্নতার, পরে বিরোধের সৃষ্টি করল। সংখ্যালঘু মুসলমান সংখ্যাগুরু হিন্দুকে মিত্র হিসেবে না দেখে, শত্রু হিসেবে দেখতে শিখল। এবং ইংরেজের রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে যে ভূমিকাটা তার নিজের পক্ষে নেওয়া স্বাভাবিক সেটাই নিয়েছে। বিভেদকে উৎসাহিত করেছে, শাসনের স্বার্থে। শেষ পর্যন্ত ওই রাষ্ট্র ভেঙে যে দুটো হলো, এবং হওয়ার পরও কোনোটিতেই যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হলো না, তার কারণ ইংরেজ আমলে সৃষ্ট ওই সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিরোধ।
আসল ভাগটা ছিল শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির। সেই ভাগাভাগিটাকে অস্পষ্ট ও আচ্ছাদিত করে রাখবার কাজে ধর্ম খুবই সাহায্য করল তার নষ্টপুত্র সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে। যে দ্বন্দ্বটা বাঁধার কথা ছিল শ্রেণিতে শ্রেণিতে, তা বাঁধল সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে। স্বাধীনতার অন্য নাম হয়ে দাঁড়াল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
২
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। কিন্তু এ মূলনীতিগুলো বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটি একটি মর্মান্তিক সত্য। রাষ্ট্রের হওয়ার কথা ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ ইহজাগতিক। কিন্তু রাষ্ট্র তা হয়নি, কেন যে হয়নি তার কারণগুলো বেশ স্পষ্ট। প্রথম সত্য হলো এই যে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থটাই শাসক শ্রেণির কাছে পরিষ্কার ছিল না। এমনকি তাদের কাছেও নয়, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাঁরা ইহলৌকিকতা বোঝাননি, বোঝাননি এই প্রয়োজনটা যে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে ফেলতে হবে পরস্পর থেকে, বরং উল্টো বুঝিয়েছেন, সব ধর্মের সমান অধিকার এবং পারলে আরও বেশি ধর্মচর্চা করা।
৩
এসব হলো ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের ঘটনা। পাশাপাশি এ সত্যও তো রয়ে গেছে যে উপমহাদেশের যে সাংস্কৃতিক ভূমি ধর্মবাদিতা ও ধর্মভীরুতার বিকাশের পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী, সে ভূমি বাংলাদেশেও বিদ্যমান। বাংলাদেশে তার উর্বরতা শক্তি বরং বেশি। কেননা দেশটি অনেক বেশি দরিদ্র, অনেক বেশি পশ্চাৎপদ। দীর্ঘকাল এ ভূমি পরাধীন ছিল। আজও সে বিশ্ব পুঁজিবাদের অধীন। কাজেই মানুষ এখানে আত্মসমর্পণে অভ্যস্ত। সে আত্মসমর্পণ করেছে বিদেশি শাসকের কাছে, করেছে ভাগ্যের কাছে। তার আত্মবিশ্বাস নেই। তার জন্য খুবই প্রয়োজন পারলৌকিক আশ্রয়ের। যে জন্য ধর্মবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতা দুটোই টিকে আছে এ দেশে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ