প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে বিআইডব্লউটিএ, বিআইডব্লউটিসি, রেলওয়ে, চা বোর্ড, শিপিং কর্পোরেশনসহ ১০টি সেক্টর কর্পোরেশনের সদর দফতর ঢাকা থেকে সরিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী বিআইডব্লউটিএ এবং বিআইডব্লউটিসির সদর দফতর বরিশালে, চা বোর্ডের সদর দফতর সিলেটে, শিপিং কর্পোরেশন ও রেলওয়ের সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর মেধা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছিলেন প্রশাসনকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। তিনি বুঝেছিলেন বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে না। সেই সাথে তিনি বলেছিলেন ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নে জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি এক সময় ঢাকা নগরীকেই অচল করে ফেলবে। তাই তিনি প্রথম পর্যায়ে ১০টি সেক্টর কর্পোরেশনের দফতর ঢাকা থেকে দ্রুত বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সুসম উন্নয়নের জন্যে যে চিন্তা ও কর্মপন্থা গ্রহণ করেন, তা আজো আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। এই উপলব্ধি ও বাস্তবতা বোঝার জন্য আমাদের অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদদের গবেষণা করতে হচ্ছে। গবেষণা করতে করতে তারা গলদঘর্ম হচ্ছেন।
সম্প্রতি ঢাকায় ‘আরগনাইজেশন অ্যান্ড বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট: সিলেক্টেড ফাইন্ডংস ফোরাম বিআইডিএস-পিআরআই রিসার্চ’ র্শীষক এক সেমিনারে বলা হয়েছে— ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নে, ঢাকাকেন্দ্রিক অপরিকল্পিত নগরায়ণে বছরে জিডিপির ৬ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। যানজট, দূষণ, উচ্চ তাপমাত্রায় কমে যাচ্ছে নাগরিকদের কর্মক্ষমতা। ওই গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকা বিকেন্দ্রীকরণ করলে ৬০ শতাংশ ও চট্টগ্রাম বিকেন্দ্রীকরণ করলে ২০ শতাংশ সুবিধা বাড়বে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ঢাকার বদলে প্রান্তিক শহরে বিনিয়োগ করলে বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে।
রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মফস্বলের উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।
উপরোক্ত সেমিনারের কয়েকদিন পর ঢাকায় ‘বাংলাদেশের সুষম নগরায়ণ ও উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ: নীতি ও পরিকল্পনা প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আরও একটি সেমিনার বা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সংলাপেও বলা হয় ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ননীতি দেশের সমগ্রিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। এতে দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। সেমিনারের প্রস্তাবনায় বলা হয়—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সব কিছু বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রস্তাবনায় বলা হয়, রাজধানীতে নতুন বড় প্রকল্প বন্ধ করে অঞ্চলিক শহরগুলোয় প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা স্থানান্তর করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, ন্যাশনাল স্পেশাল প্ল্যান কার্যকর করে অঞ্চলিক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র গড়ে তুললেই সুসম উন্নয়নের পথ তৈরি হবে।
এখন প্রশ্ন হলো—কারা করবে? এই প্রশ্নে উভয় সেমিনারে এই বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে রাজনীতির বাইরে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরই টেকসই উন্নয়ন নির্ভর করে। এ বিষয়ে অনেকেই বলতে পারেন রাজনৈতিক নেতাদের তো এ বিষয়ে আগ্রহ আছেই, তারা তো প্রায়শই বলেন— বিকেন্দ্রীকরণের কথা। মূলত রাজনৈতিক নেতারাই এই বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা দেন। তাহলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা হলো— রাজনৈতিক নেতারা নিজ শহরে না থেকে তারা এখন ঢাকার অভিজাত এলাকায় থাকেন। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যানরাও গুলশান, বানানীতে থাকেন। এই যখন অবস্থা তাহলে তারা গ্রামের উন্নয়ন চাইবেন কেন? ডিসি, এসপিরা নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকলেও তাদের স্ত্রী, পুত্র-কন্যারা থাকেন ঢাকায়। শুধু তাই নয়, উপজেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারদের স্ত্রী-পুত্ররাও থাকেন ঢাকায়।
এই বিষয়ে আবারো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিকেন্দ্রীকরণের দিকে ফিরে যাই। জিয়াউর রহমান বিকেন্দ্রীকরণের নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি তা কার্যকর করেন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য তাকে হত্যা ও হত্যার কয়েক মাসের মধ্যে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের ফলে ওই বিকেন্দ্রীকরণ উল্টে যায়। আর এই উল্টে দেওয়ার কাজটা করেন আমলারা। প্রশাসনের শীর্ষ আমলারা।
অবশ্য, তারা কাজটি শুরু করেন জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশাতেই। তিনি যখন ১০টি সেক্টর কর্পোরশন সত্যি সত্যিই ঢাকা থেকে সরিয়ে দেন তখনই। এই বিষয়ে আমার যতদূর মনে পড়ে তা হলো— বিআইডব্লউটিএ স্থানান্তর আদেশ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে সদর দফতর বরিশাল থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঢাকায় বিক্ষোভ করেন। সবশেষে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেন। এই ধর্মঘটের ফলে দেশের নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এই ধর্মঘট ও আন্দোলনের ইন্ধনদাতা ছিলেন আমলারা। আমলাদের ইন্ধনেই ওই ধর্মঘট হয়।
তবে ওই ধর্মঘটের কাছে জিয়াউর রহমান মাথা নত করেননি। কিন্তু ওই ঘটনার অল্প দিনের মধ্যে তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, আমলারা কোনো মতেই ঢাকা ছাড়তে চান না। আর চান না বলেই ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নকে অগ্রধিকার দেন। একইভাবে রাজনীতিকরাও আর নিজ নিজ এলাকায় থাকেন না। তারা থাকেন ঢাকায়। তাই তাদেরও অগ্রাধিকার ঢাকা। এমনকি সরকারও এই রাজনীতিক নেতা, মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকার জন্য রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দেয়। এই অবস্থায় আজকের বাস্তবতা উপলব্ধি করে যেসব গবেষণা ও প্রস্তাবনা আসছে তাকে আগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিকল্পনায় রূপ দেওয়া খুব সহজ হবে না। এই জন্য প্রয়োজন দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। জাতির সৌভাগ্য যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান রাজনীতিবিদদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, দেশ-দেশের মানুষের সঙ্গে বেইমানির ফল কী হয়। তাই আমার বিশ্বাস অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি হবে। আর অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা যেহেতু এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন, তাই আমার বিশ্বাস এ বিষয়ে পরিকল্পনাবিদরা পরিকল্পনা করতে বাধ্য হবেন। তাছাড়া প্লানিং কমিশনে এখন যারা বসে আছেন তারাও জুলাই অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষদর্শী। তাই তারা এ বিষয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন আনবেন— এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
অবশ্য, এই প্রত্যাশা পূরণে কতদিন লাগবে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। আর পদক্ষেপ নেওয়া হলে আগে পরে যে সুফল পাওয়া যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
মাহবুব আলম: লেখক ও সাংবাদিক।
এমজেএফ