ঢাকা, সোমবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

বিনিয়োগ বন্ধ্যত্বে আকারে-নিরাকারে বেকার বৃদ্ধি : বাড়ছে নেশা-নৈরাজ্য

মোস্তফা কামাল | সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
আপডেট: ০৮:৪৬, অক্টোবর ১৩, ২০২৫
বিনিয়োগ বন্ধ্যত্বে আকারে-নিরাকারে বেকার বৃদ্ধি : বাড়ছে নেশা-নৈরাজ্য মোস্তফা কামাল

বেকারত্বের যাবতীয় কারণ বিদ্যমান রেখে নতুন আরো বেকার তৈরির মহা ধুম চলছে। নানা মিঠা কথা শোনানো হলেও বিনিয়োগে খরা কাটার লক্ষণ নেই।

জাপান-সিঙ্গাপুরের মতো চাকরির বাজার বিস্তারের বাহারি কথা কচলালেও কর্মসংস্থানে চরম আকাল। পুরান বেকারের সঙ্গে যোগ হচ্ছে হাজারে হাজার নয়, লাখ লাখ বেকার।

সরকারি হিসাবেও বেকারত্বের চিত্র আড়াল করার সুযোগ নেই। নতুন-পুরান মিলিয়ে এই বেকাররা কাজ খুঁজতে খুঁজতে কাহিল-বেসামাল। খেই হারিয়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে নানা মন্দকাজে।  একদিকে বিনিয়োগকারীদের অস্বস্তি, আরেকদিকে নিয়োগের আশায় বুক বেঁধে থাকা বেকারদের আর্তনাদ।

সরকারি সর্বশেষ হিসাবে  বেকার জনগোষ্ঠী ২৬ লাখ ২০ হাজার। যা আগের বছরের তুলনায় দেড় লাখ বেশি। কম শিক্ষিত বা নিরক্ষরের তুলনায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ধারণার বাইরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুসারে বেকারদের সাড়ে ১৩ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী।

৭.১৩ শতাংশ উচ্চ মাধ্যমিক পাস। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী বা উচ্চ মাধ্যমিক সনদধারী। একটা সময় পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রতিবছর চাকরির বাজারে ঢুকেছে ২০ থেকে ২৪ লাখ কর্মক্ষম মানুষ। সেখানে এখন নতুন কর্মসংস্থান দূরের কথা, কর্মসংস্থান খোয়া যাচ্ছে হিসাব ও ধারণার বাইরে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে।

তার ওপর মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যোগ হচ্ছে নতুন বেকার। যাদের চাকরি যায়নি, তাদের সময় যাচ্ছে চাকরিচ্যুতির আতঙ্কে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া এবং চাকরি হারানোর নতুন আতঙ্কের বিষ নীল করে তুলছে সমাজের নানা স্তরকে। মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো ৮ শতাংশের ওপরে। বাজারে দ্রব্যমূল্য অনেকাংশে বেড়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট আরো বেড়েছে। যে আয় তা দিয়ে সংসার চলে না। অবস্থাটা হুট করে এমন হয়নি। ২০২২-২৩ সাল থেকে কর্মসংস্থানে ভাটা পড়তে থাকে। ২৪ সালে এসে চরম ঝাঁকুনি। গেল বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ভর করায় একে একে বন্ধ হতে থাকে শিল্প-কারখানা। এতে শুধু বিনিয়োগকারীদের মাথায় বাড়ি পড়েনি, আক্রান্ত হন শ্রমিক-কর্মচারীরাও। শুধু বেকারত্ব নয়, কর্মসংস্থানের কাঠামো, বৈষম্য ও ভবিষ্যৎ সংকট আরো বেড়েছে।

বেকারত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নীতি অনুসরণ করে থাকে বিবিএস। সে অনুযায়ী কর্মক্ষম তবে কোনো কাজে নিয়োজিত নয়, কাজ খুঁজে বেড়ায় এবং সুযোগ পেলে কাজে যোগ দিতে প্রস্তুত থাকে-এ ধরনের ব্যক্তিকে বেকার বলা হয়। সপ্তাহে মাত্র এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ পেলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয় না। পরিবারের জন্য কেউ হাঁস-মুরগি পালন করলেও তাকে বেকার বলা হয় না। এমনকি উৎপাদনশীল কাজে মজুরি না পেলেও তাকে বেকার গণ্য করা হয় না। আর ১৫ বছর এবং তার বেশি বয়সীদের শ্রমশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন নীতির ভিত্তিতে দেশে বেকারের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় হয় না। বেকারের বাস্তব সংখ্যাটা আরো বেশি। এ নিয়ে অনেক গবেষণার দরকার পড়ে না। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরির শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে লাখ লাখ প্রার্থীর আবেদনেই পরিস্থিতি বোধগম্য। দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকাও দৃশ্যমান। এর সম্ভাব্য পরিস্থিতি মারাত্মক। বিভিন্ন জায়গায় নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে বেকাররা। হতাশায় ঝুঁকছে নেশার রাজ্যেও। নেশার টাকার জন্য হামলে পড়ছে মা-বাবাসহ স্বজনদের ওপর। তা গড়াচ্ছে খুন-খারাবিসহ নানা সামাজিক অপরাধে।

কয়েকটি কেস স্টাডিতে জানা গেছে, কাজ না পাওয়া বেকার ও কাজ হারিয়ে বেকার হওয়া বিশালসংখ্যক কর্মহীনের একটা অংশ মাস্কে মুখ ঢেকে ভ্যান-রিকশা চালানোর কাজে নেমেছে। রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অনেকে সেই সংখ্যারই অংশ। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এই রিকশার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এরা কত বেপরোয়া ও আক্রমণাত্মক তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। রাজধানীতে ঠিক কতসংখ্যক ব্যাটারি রিকশা চলছে, তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। কোনো কেন্দ্রীয় নিবন্ধন বা লাইসেন্সিং ব্যবস্থা না থাকায় মন চাইলেই এ কাজে নেমে পড়ার সুযোগটি নিচ্ছে তারা। তাদের নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা নেই। ঘোষিত-অঘোষিত, দেখা-অদেখা বেকারের এ কিলবিল অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ছে। বেকারের ভাগাড় বা ফ্যাক্টরি উপচে পড়ার মাঝে আকারে-নিরাকারে ঘুরে বেড়ানো এ বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর হিসাব অসম্ভব প্রায়। নিয়ন্ত্রণও অসম্ভব। বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি এবং বেসরকারি খাতের শ্লথগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে। এরই মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। মুদির দোকান, কাপড়ের দোকানগুলোয় সাধারণ মানুষ বাকিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে দাম পরিশোধ করতে না পারায় গ্রামের দোকানগুলো লাটে উঠছে। ওই সব দোকানদারও বেকার দশায়। নানা আজেবাজে কাজে জড়াচ্ছে তারা। এতে অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক নৈরাজ্য।

দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ শিক্ষিত বেকারের শিকার। বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মসংস্থান না হওয়ায় হতাশায় ভুগছে। এটি শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, গোটা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য গভীর ক্ষত। সরকারিভাবে এ ক্ষত সারানো সম্ভব নয়। অনেকেই বছর বছর ধরে বিসিএস, ব্যাংক বা অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না। এতে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত। সেখানে বিশেষ ভরসা বেসরকারি খাত। গত কয়েক বছরের অনবরত নাকানিচুবানির মাঝে মাস কয়েক ধরে বেসরকারি খাত ধরাশায়ী। বিনিয়োগ তলানিতে। বিনিয়োগ ছাড়া নিয়োগ অবান্তর। দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোয় একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। দেশের কর্মসংস্থানের প্রায় ৯৫ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বাংলাদেশের বেসরকারি খাত হালে চরম সংকটে। মিল-কারখানাগুলোর চাকা সচল রেখে, উৎপাদন বহাল রাখা গেলে আজ এ অবস্থা হয় না।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।