ঢাকা, শুক্রবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

ইসরাইলের শ্রেষ্ঠত্ব ও আমাদের বিশ্বজয়

মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান, সচিব(যুগ্ম জেলা জজ), ভূমি কমিশন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৪
ইসরাইলের শ্রেষ্ঠত্ব ও আমাদের বিশ্বজয়

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। এর সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। ২০০৬ সালে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে।

ধারণা করা হয়, দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সে সময় বসতি স্থাপন করে। পরে এ অঞ্চল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং স্থানীয় ও বিদেশি দ্বারা শাসিত হয়। আর্য জাতির আগমনের পর খ্রিস্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক অবধি গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করে।

এর ঠিক পরেই শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এ এলাকার ক্ষমতা দখল করেন। প্রায় একশ’ বছরের অরাজকতা বা মাৎসন্যায় পর্ব শেষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হয় এবং চারশ’ বছর ধরে শাসন করে।

এরপর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। দ্বাদশ শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের প্রবর্তন ঘটে। পরে বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান এবং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

১২০৫-১২০৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী নামে একজন তুর্কী বংশোদ্ভূত সেনাপতি রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করেন। ষোড়শ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসার আগ অবধি বাংলা স্থানীয় সুলতান ও ভূস্বামীদের হাতে শাসিত হয়।

বাংলায় ইয়োরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে। ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে।

শুরু হয় দুশ’ বছরের ইংরেজ শাসন। প্রায় দুশ’ বছরের দুঃসহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পেরিয়ে পাকিস্তানিদের শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা অহংকার করতে পারি যে, ইতিহাসে এটাই বাঙালিদের প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেনও তাঁর বিভিন্ন লেখায় এ কথা বলেছেন।

রঙিন মুখ ও প্রাচীন সভ্যতা  
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। পৃথিবীর এ ভূ-ভাগটুকু আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর। এ সৌন্দর্যের একটি দিক হচ্ছে এখানে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ মিলেমিশে থাকে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ এটি।

১৬ কোটি মানুষের এ দেশে সাড়ে চার কোটির মতো পরিবার আছে যা ইউরোপ–আমেরিকায় বিরল। এটা আমাদের বিশাল ও অতুলনীয় ঐশ্বর্য। ভারতীয় উপমহাদেশ ব্যতীত অন্য কোনো অঞ্চল এ গৌরবের অধিকারী হতে পারেনি।

আর আমাদের এ অর্জনও কিন্তু একদিনের নয়। এটা বহু শতাব্দী জুড়ে চর্চিত আচরণের ফসল। ছোটবেলায় পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের একটি কবিতা পড়েছিলাম। কবিতাটির নাম ছিল ‘মামার বাড়ি’ । কথাগুলো এখনো হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায় ‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা/ফুল তুলিতে যাই;/ফুলের মালা গলায় দিয়ে/মামার বাড়ি যাই। /ঝড়ের দিনে মামার দেশে/আম কুড়াতে সুখ;/পাকা জামের মধুর রসে/রঙিন করি মুখ।

এটা একটি ভালো কবিতাই নয় বরং এটা আমাদের ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর পারিবারিক পরিমণ্ডলকে তুলে ধরে। মামাবাড়ি, নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি, খালাবাড়ি কিংবা ফুফুবাড়ি বেড়াতে গেলে শুধু মুখই রঙিন হয় না। হৃদয়-মন সব কিছু রঙিন হয়ে উঠে।

বাবা-মা , চাচা-চাচী, দাদ-দাদী, নানা –নানী, মামা-মামী, খালা-খালু –এঁদের সবাইকে নিয়ে আমাদের দিন কাটে অসামান্য বিশেষত্বের মধ্যে দিয়ে। যাঁরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে ওল্ডহোমে পাঠানোর মধ্য দিয়ে ঝামেলামুক্ত হতে চায়, তাঁরা আর যাই হোক সভ্য হতে পারে না। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, পারিবারিক মিল-বন্ধন, সামাজিক ন্যায়বোধ, নৈতিক মানদণ্ড, ‍বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও চারিত্রিক উদারতা আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতার পরিচায়ক।

উজ্জ্বল পথ চলার আলোকিত সোপান
গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার এ দেশে প্রায় প্রতি বছরই মৌসুমী বন্যা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রলম্বিত বন্ধুরতা সত্বেও বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে।

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। কিন্তু আয়তন হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৩তম। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। তারপরও সত্তর দশকের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ও জিডিপি  বেড়েছে। দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।

এটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য। তবে মাথাপিছু গড় আয়, জিডিপি ও দারিদ্র্য নির্ধারণী সূচকগুলো নিয়ে অনেকেই তাত্ত্বিক তর্ক জুড়ে দেন। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই। খোলা চোখে যা দেখেছি তাই বলি। ছোটবেলায় আশির দশকের শেষের দিকে ঈদ-পার্বনের সময় গ্রামে খুব কম মানুষের গায়ে নতুন জামা দেখতাম।

হাতেগোনা কজনের পায়ে জুত-স্যান্ডেল দেখা যেত। নব্বই সালের দিকেও স্কুলে যাওয়ার সময় বেশিরভাগ  রিক্সাওয়ালাকে খালি পায়ে দেখতাম। আমাদের আরেকটি বড় অর্জন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে।

আর এ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে আছে বিপুল সংখ্যক প্রাণবন্ত যুবক-যুবতী। তাদের মৌলিক বিশালত্ব সংখ্যা নয় বরং  মেধা-মনন ও দেশপ্রেমে। তারাই আমাদের সত্যিকার ভবিষ্যৎ। তাদের মাঝে লুকিয়ে আছে জাতির উজ্জ্বল পথ চলার আলোকিত সোপান।

আমাদের গৌরবময়  ইতিহাস ও ‘পেনাল কলোনি’ অস্ট্রেলিয়া
মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে কাবুল অবধি একটি একক রাষ্ট্র ছিল। দক্ষিণ ভারতের কিছু এলাকা বাদ দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে আরব সাগর অবধি বিস্তৃত ছিল এ রাজ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এ রাজ্য প্রাচীন গ্রীসের তুলনায় খুব একটা পিছিয়ে ছিল বলা যায় না।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর বিখ্যাত ছাত্রদের অবদান এটার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অর্থনীতির ধ্রুপদ গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’-এর  লেখক কৌটিল্য বা চাণক্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সংস্কৃত ব্যকরণবিদ পাণিনি, বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্র  ‘চারকা-সংহিতা’র লেখক চারকা, রাজনীতি-জ্ঞান সম্বলিত গ্রন্থ ‘পঞ্চতন্ত্র-এর লেখক বিঞ্চুশর্মা এবং গৌতম বুদ্ধের ব্যক্তিগত চিকিৎসক, প্রাচীন নাড়ি বিশেষজ্ঞ ও শল্যবিদ জিবাক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।

তক্ষশীলা  বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব অসাধারণ ছাত্ররা যখন অসাধারণ সব কীর্তির স্বাক্ষর রেখে চলেছিল তখন ইউরোপ আমেরিকার সভ্য মানুষগুলোর পূর্ব পুরুষেরা বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে প্রতিষ্ঠিত হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। ওই সময়ে এটা ছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যপীঠ । তিব্বত, চায়না, পারস্য, গ্রিক এসব দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী এ বিদ্যায়তনে পড়তে আসতো। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক  হিউইয়েং সাং এবং ফা হিয়েন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।

হিউইয়েং সাং এবং ফা হিয়েন মূলত সেই বিপুল সংখ্যক জ্ঞানপিপাসু বিদ্যার্থী দলেরই দুই বিখ্যাত সদস্য। ফিরে গিয়ে  তাঁরা আমাদের জ্ঞানকেই নিজ দেশের ধর্মচর্চা ও অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে কাজে লাগান।

চীন অত্যন্ত পুরোনো সভ্যতার দেশ। এতে কোনো দ্বিমত নেই। অথচ এ প্রাচীন সভ্যতায় আমাদের অবদান কম নয়। এটা নিয়ে গর্ব করা যায়। এ সময়ের ধনী দেশগুলোর এ রূপ গৌরবময় ইতিহাস নেই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোঁয়া পেয়েছে তখন ইউরোপ-আমেরিকাতে লোকজন নেংটি পরে ঘুরে বেড়াতো।

অস্ট্রেলিয়ার কথা তো বলাই বাহুল্য। মাত্র দু-তিন জেনারেশন আগেও তাঁদের কীর্তিকলাপ ছিল হীন ও লজ্জাজনক। সাবেক ‘পেনাল কলোনি’ অস্ট্রেলিয়ার তেমন কোনো ঐতিহাসিক গৌরবগাঁথা খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ আজ আমাদের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা এসব দেশে সেটেল করার জন্য মুখিয়ে থাকে।

সূর্যসেনদের দেখনো পথেই ‘দৃষ্টি’র অনিবার্য আবির্ভাব
তিব্বতের স্বাধীনতাকামী আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা সারা বিশ্বে সাম্য,  স্বাধীনতা ও মানবতার জয়গান গেয়ে চলেছেন। বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী নেতানেত্রী আরাকানে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে কোনো সমালোচনা করেননি। সেই দেশের নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সান সূচিও কিছু বলেননি।

দালাইলামা সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীত গিয়ে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছেন। অথচ আশ্চর্য হবার মতো বিষয় হচ্ছে তিব্বতের প্রাচীন শিক্ষায় মৌলিক অবদান বাঙালি বৌদ্ধ ভিক্ষু অতীশ দীপংকরের। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে পাল রাজত্বের সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন অতীশ দীপংকর। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষারমান নিম্নমুখী হয়ে যাচ্ছে মনে করে রাজা ধর্মপাল এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বন্দর নগরী। পর্তুগীজ বণিকেরা চট্টগ্রাম বন্দরকে  ‘পোর্ত গ্র্যান্ডে’ বা ‘বড় বন্দর’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। ব্যবসা হল বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। ব্যবসা বানিজ্যের যথাযথ গতি প্রকৃতির ওপর যেকোনো দেশের জাতীয় উন্নয়ন নির্ভর করে।

ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবসার প্রতি চট্টগ্রামের মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার। ব্যবসা ও শিল্প-বানিজ্যে দুঃসাহসিক ঝুঁকি গ্রহণে চট্টগ্রামবাসী কলম্বাস, ভাস্কো- দা-গামা কিংবা সিন্দাবাদের মতোই দুঃসাহসী।

বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলো ও ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম ভ্রমণে আসেন। তাঁরা উভয়ে আমাদের প্রিয় এ নগরীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। একটি  কিংবদন্তি চালু আছে  যে,  শ্রীলঙ্কার গোড়া পত্তনকারী রাজা বিজয় সিংহ চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

সিলন এবং পরে শ্রীলঙ্কা শব্দটি তাঁর নাম থেকে এসেছে। ইতিহাসের পরিক্রমায় বলা যায় দৃষ্টির আবির্ভাব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা আমাদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যগত চর্চার অনিবার্য ফল। মাস্টার দ্য সূর্যসেন ও বিপ্লবী বিনোদবিহারীদের পরবর্তী প্রজন্মই হল ‘ দৃষ্টি’র মতো প্রতিষ্ঠান। এটার সৃষ্টি এবং কার্যক্রম নিঃসন্দেহে দূরদর্শি পদক্ষেপ।

ভালোবাসার একই সুতোয় ভবিষ্যতের বিজয়ীরা
‘দৃষ্টি’  ইতোমধ্যে ঈর্ষণীয় সুনাম অর্জন করেছে। ‘দৃষ্টি’তে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্ররা আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারছে অতি অল্প বয়সে। সমাজের ভালো মানুষগুলোর সংস্পর্শে এসে চরিত্র গঠনের সুযোগ পাচ্ছে।

‘দৃষ্টি’র  জ্ঞানচর্চা এবং পাঠাদান ছাত্রদের রক্তের শিরা-উপশিরায় মিশে প্রজন্ম পরম্পরায় পৌঁছে যাবে।
দু’জন মেসেডোনিয়ান সারা পৃথিবী জয় করেন। একজন হলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। অপরজন মহিয়সী নারী মাদার তেরাসা। একজন তলোয়ার দিয়ে। আরেকজন হৃদয় দিয়ে। হৃদয়ের বিজয় চিরস্থায়ী-অবিনশ্বর। আলেকজান্ডারের বিজয় স্থায়ী হয়নি।

তাঁর মৃত্যুর পর সেনাপতি সেলুকাসের রাজত্বও স্থায়ী হয়নি। যুদ্ধে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে চরমভাবে পরাজিত হবার পরই হয়তো তিনি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন কী বিচিত্র এই দেশ! এখানকার মানুষের বীরত্ব ও সাহসিকতা তিনি যথার্থভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।

যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর নিজের মেয়েকে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাতে তুলে দিতে হয়। বলা যায়, সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটোর ছাত্ররা চরমভাবে পরাস্ত হয়েছিলেন তক্ষশীলার ছাত্রদের কাছে।

প্রসঙ্গত, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত নিজেও তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। যাই হোক, সুখের বিষয় হল হৃদয় দিয়ে যাঁরা জয় করেন পৃথিবীর শেষ দিন অবধি তাঁরা অপরাজিত থেকে যাবেন। ‘দৃষ্টি’ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হয় এটার  শিক্ষার্থীরা হৃদয় দিয়ে এ পৃথিবীকে সারা জীবনের জন্য জয় করে নিবে।

পৃথিবীর উত্তর- দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সবদিকে তাদের ভালোবাসার জয়ধ্বনি হবে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো তথা সিন্ধু সভ্যতার যোগ্য উত্তরসূরি ‘দৃষ্টি’ র শিক্ষার্থীরা। মায়া, ইনকা, গ্রিক, সুমেরীয়ায়, মেসোপটেমিয়া, চৈনিক ও মিশরীয় সভ্যতা ছাড়াও পৃথিবীর তাবৎ মহৎ অর্জনকে ভালোবাসার  একই সুতোয় বাঁধার নিরন্তর প্রচেষ্ঠায়রত আমাদের প্রিয় ‘দৃষ্টি’ ।

ইসরাইলীদের মতো বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য
মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ছুরির ফলার মতো দেখতে ২১ থেকে ২২ হাজার বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট একটি রাষ্ট্র ইসরাইল। জনসংখ্যা মাত্র ৮০ লাখের কিছু বেশি। অথচ বিশ্ব রাজনীতিতে কত প্রভাবশালী এই রাষ্ট্র। পৃথিবী জুড়ে ব্যাংকিং, বীমা, অস্ত্র, মিডিয়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যবসা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ইসরাইলের নাগরিকরাই নিয়ন্ত্রণ করছে।

পুরো পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সমরবিদ্যাসহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই ইসরাইলীদের শ্রেষ্ঠত্ব। বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল পুরস্কারের তালিকায় চোখ বুলালে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ঠ হয়ে উঠবে।

জাতিসংঘ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি বৈশ্বিক গুরুত্ববহ প্রতিষ্ঠানগুলোতে মূল পজিশনে বসে ইসরাইলীরাই কলকাঠি নাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গভর্মেন্ট ও প্রায় সবগুলো অঙ্গরাজ্যে ইসরাইলীদের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। অথচ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ চ্যাম্পিয়ন শিপ, ২০১৩ পর্বের ‘দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি’ বিভাগে আমাদের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি গত তিনবারের চ্যাম্পিয়ন তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়কে পরাজিত করে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

এ বিজয় অত্যন্ত ইঙ্গিতবহ। এ বিজয় যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সারা পৃথিবীকে জয় করার সামর্থ্য আমাদের আছে। আমাদের যে বিশাল তরুণ প্রজন্ম আছে তারা অত্যন্ত মেধাবী। আমাদের গড় মেধা ইসরাইলীদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

আমাদের যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে পর্যাপ্ত নার্সিং। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক কারণেই ফুটবল-ক্রিকেটে ভালো করার চেয়ে পদার্থ-রসায়নে ভালো করা আমাদের জন্য সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। এতে পড়াশোনা বাড়বে। গবেষণা সমৃদ্ধ হবে। ফলে অনেকগুলো এ পি জে আবদুল কালাম  উঠে আসবে। এটাই আমাদের দরকার বেশি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ধমকের সুরে কথা বলেন। এটা আমাদের পক্ষেও সম্ভব।

জাস্ট পঞ্চাশ বছরের লক্ষ্য নিয়ে শুরু করলেই হয়। কিছু বিশেষ বিষয়ে সব সরকারের জন্য অলঙ্ঘ্য কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করে এগোতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্য থেকে লাখ খানেক মেধাবী, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক চিকিৎসাবিদ, পদার্থবিদ ও রসায়নবিদ তুলে আনা সম্ভব।

এইডস কিংবা ক্যান্সার চিকিৎসায় গবেষণা করা যায়। কোনো জাতির ভাগ্যে সৃষ্টিকর্তা কী লিখে রেখেছেন তা তো বলা যায় না। শুধু এ দু ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া গেলে পুরো জাতিই এক ভিন্ন উচ্চতায় চলে যেতে পারে।

সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনা করে কাজ করতে থাকলে উনি হয়তো সম্মানের সিংহাসন আমাদের জন্যই লিখে রেখেছেন। ‘দৃষ্টি’র এ অসামান্য আয়োজন এবং এ মেধাবী মুখগুলো দেখে আমার হৃদয়ের দীর্ঘ লালিত স্বপ্নগুলো বলে ফেললাম। কেন জানি মনে হচ্ছে ‘দৃষ্টি’ যেন সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। আভিনন্দন দৃষ্টি-পরিবারকে!

প্রার্থনা ও সক্রেটিস কিংবা প্লেটোর ক্ষুদে ভার্সন
সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, ইপিকিউরিয়াস, জেনো থেকে শুরু অনেক গ্রিক দার্শনিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন কিংবা বিতর্ক শিক্ষা দিতেন। অথবা অন্য কোনোভাবে নিজেদেরকে বিতর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতেন। বাজার কিংবা জনসমাগম হতো এরূপ জায়গাকে তাঁরা বিতর্কের স্থান হিসেবে বেছে নিতেন।

এ জায়গাটাকে বলা হত আগোরা। ঠিক এ স্থানটি রোমান দার্শনিকেরা বলতেন ফোরাম। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে প্রয়াত শিল্পী মান্নাদের গানের সেই আড্ডা গ্রিক ও রোমান দার্শনিকদের মধ্যেও ছিল।

আর তাঁদের সেই আড্ডারই নবরূপ আজকের এ সমাবর্তন। ‘দৃষ্টি’ পরিবারের সদস্যরা যেন একেকজন সক্রেটিস কিংবা প্লেটো। আর সামনে উপস্থিত শিক্ষার্থী বন্ধুরা যেন সক্রেটিস কিংবা প্লেটোর খুদে সংস্করণ হয়ে আমাদের সামনে বসে আছে।

বাংলাদেশ: সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।