ঢাকা, বুধবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ০৩ জুলাই ২০২৪, ২৫ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

বইমেলার টুকিটাকি

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৪
বইমেলার টুকিটাকি

১.
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ঈদের পুরোদিন শেষ করে রাতে যখন ঘুমাতে যেতাম তখন দুঃখে বুকটা ভেঙে যেতো- মনে হতো, হায়রে এতো আনন্দের ঈদটা শেষ হয়ে গেল? এখন বয়স হয়েছে, ঈদের রাতে ঘুমানোর সময় দুঃখে বুক ভেঙে যায় না, কিন্তু যখন বইমেলা শেষ হয়ে যায় তখন বুকটা টনটন করতে থাকে! আমার শৈশবের ঈদের রাতের কথা মনে পড়ে যায়।

এই লেখাটি যখন ছাপা হবে সেদিন বইমেলার শেষ দিন।

আমাদের এই বই মেলাটি খুবই  চমকপ্রদ। প্রকাশকরা চাপাচাপি করে যদি বাংলা একাডেমিকে রাজি করিয়ে সেটাকে আরো লম্বা করে মার্চ মাসে নিয়ে যায় তাহলে আবিষ্কার করবে কেউ মেলায় আসছে না। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনেও রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে মেলায় যাবে কিন্তু মার্চ মাসে ফ্রি চা কফি খাওয়ালেও কেউ মেলায় যাবে না। ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া অন্যমাসে বইমেলা ব্যাপারটা রীতিমতো অন্যায় একটা ব্যাপার! কী আশ্চর্য একটা ঘটনা- এই দেশ ছাড়া আর কোনো দেশে এরকম বিচিত্র ব্যাপার নিশ্চয়ই দেখা যায় না!

এবারের বই মেলাট‍া একটু অন্য রকম ছিল। প্রথমবার বই মেলাটি শুধুমাত্র বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ না রেখে সোহরাওযার্দী উদ্যানেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রথমবার যখন আমি বই মেলায় গিয়েছি সাংবাদিকরা সবাই আমাদের জিজ্ঞেস করেছে, মেলার এই নতুন নতুন কাঠামো সম্পর্কে আমাদের কী ধারণা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের খালি যায়গা কমতে কমতে এত ছোট হয়ে গেছে যে বই মেলায় প্রকাশকদের জায়গা দেওয়াটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো। তাই আমরা যখন শুনেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও মেলাটা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন আমি বেশ খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমদিন মেলায় গিয়ে আমার একটু আশাভঙ্গ হয়েছিল। তার কারণ আমাদের বই মেলাটা একটু অন্য রকম। এটা কখনোই শুধু বই বিক্রি করার একটা আয়োজন ছিল না। এটা ছিল একটা উৎসবের মতো, মানুষজন ঘুরছে ফিরছে, বেড়াচ্ছে, কথা বলছে, চিনা বাদাম খাচ্ছে, গান শুনছে, লেখকের অটোগ্রাফ নিচ্ছে। তার মাঝে যদি ইচ্ছে করে তাহলে বই নেড়েচেড়ে দেখেছে এবং যদি পছন্দ হয় (এবং টাকা থাকে) তাহলে বই কিনছে। কিন্তু এবারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশটুকুতে গিয়ে মনে হলো আমার বই মেলায় আসিনি, আছি বই বিক্রির স্টলে! বইমেলার যে একটা মধুর ভাব থাকার কথা সেটি নেই, এখানে কোনো কালচার নেই যা আছে তা হচ্ছে পুরোপুরি বাণিজ্য!

এটি একেবারে প্রথমবার তাই আমরা সবাই ধরে নিচ্ছি পরিকল্পানাটি ঠিক করে করা হয়নি। ভবিষ্যতে যখন হবে তখন আমার সবাই আশা করব পুরো বিষয়টা কেন বই বিক্রি করার কিন্তু স্টল না হয়ে এটা যেন সত্যিকারে বই মেলা হয়। দুটো অংশ যেন ঝগড়াঝাটি করে আলাদা হয়ে যাওয়া দুই ভাইয়ের মতো না দেখায়। পুরোটা মিলে যেন একটা সুখী পরিবারের মতো মেলা হয়। মেলায় হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে একজন একটা বেঞ্চের মাঝে কিংবা ঘাসের ওপরে বসে সদ্য কিনে আনা বইগুলোর পৃষ্ঠা ওল্টাতে পারে।

২.
বইমেলার সময় অনেকেই দেশের নানা জায়গা থেকে ঢাকায় আসেন শুধু বই দেখার জন্য আর বই কেনার জন্য। সবাই সেটা পারেন না, অনেকেই হিংসাতুর চোখে খবরের কাগজে বই মেলায় খবর পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সে রকম একজন সেদিন আমাকে বলেছেন, শুধু ঢাকায় কেন বই মেলা হয়? দেশের সব শহরে কেন মেলা হয় না?

খুবই খাঁটি কথা, ঢাকায় মতো দেশের সব শহরেই কেন বইমেলা হয় না? আমাদের দেশে সবকিছু কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা, কিন্তু আমরা যারা ঢাকার বাইরে থাকি আমাদের যে বইমেলা যেতে ইচ্ছে করে সেটি তো আর ভুল কিংবা মিথ্যে নয়।

আমার মনে আছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আগে শহরের কোনো জায়গা বেছে নিয়ে সেখানে বই মেলা করতো। বড় বড় প্রকাশকদের রাজি করিয়ে তাদের নিয়ে আসতো- ঢাকার মতো এরকম অবিশ্বাস্য মেলা না হলেও মোটামুটি বেশ ভালোই এক ধরনের মেলা হতো। কিন্তু শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নির্ভর করে না থেকে আরো বড় করে সেই উদ্যোগ কী নেওয়া যায় না? যদি এরকম একটা নিয়ম হয়ে যেতো, ঢাকায় মেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরে বইমেলা হয়ে যাবে তাহলে সেটা কী চমৎকার একটা ব্যাপার হতে পারতো না?

৩.
বইমেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে নতুন বইয়ের প্রকাশনা। তার সঙ্গে সঙ্গে যেটা ঘটতে থাকে সেটা হলো নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। মেলায় গেলে সব সময়ই মাইকে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের কথা শোনা যেতে থাকে। এখন আমার প্রায় নিয়মিত দায়িত্ব হয়ে পড়েছে বাংলা একাডেমির বটগাছের নিচে নজরুল মঞ্চে দাঁড়িয়ে নতুন লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা। আমি জানি না সবাই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন কী না। নজরুল মঞ্চে কয়েকজন ‘প্রফেশনাল’ মোড়ক ‘উন্মোচক’ থাকেন। নতুন লেখক একটু বিব্রত, একটু ইতস্তত ভঙ্গিতে সেখানে মোড়কে ঢাকা একটি বই (অনেক সময়েই তার সঙ্গে সঙ্গে একটা ফুলের তোড়া ও মিষ্টির প্যাকেট থাকে) নিয়ে হাজির হলে এই প্রফেশনাল মোড়ক উন্মোচকরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বই নিয়ে মোড়ক উন্মোচনের কাজে লেগে পড়েন। যে বই তারা জীবনে কখনো দেখেন নি সেই বই নিয়ে তারা যেরকম আবেগঘন ও হৃদয়গ্রাহী ধারা বর্ণনা দিতে থাকেন সেটা দেখার মতো। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাদের কথা শুনে থাকি।

মাঝে মাঝেই অনেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করার জন্য অনুরোধ করেন। আমি ঢাকায় থাকলে আনন্দের সঙ্গে মোড়ক উন্মোচন করে দেই। সবসময়ই তখন অন্য কয়েকজন লেখকও তাদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করার অনুরোধ নিয়ে হাজির হয়ে যান। একেবারে নতুন একজন লেখকের প্রথম বইটির মোড়ক যখন উন্মোচন করা হয় তখন তার চোখে মুখে আনন্দের যে একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠে তার কোনো তুলনা নেই।

আমার ধারণা বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা অন্য অনেকের থেকে বেশি। সেদিন বইমেলা শেষে আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি। হঠাৎ করে একজন লেখক আমাকে জাপটে ধরলেন। তার হাতে একটা মোড়কে ঢাকা বই। আমাকে তার মোড়ক উন্মোচন করে দিতে হবে। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি ফিরে যাচ্ছি, ভিড় ঠেলে  আবার নজরুল মঞ্চে গিয়ে এখন আর মোড়ক উন্মোচন করার সুযোগ নেই।

নতুন লেখক সেটা শুনেও বিন্দুমাত্র হতোদ্যম হলেন না-আমাকে বললেন, এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়েই তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে দিলেই সে খুশি। কাজেই আমাকে রাস্তার একপাশে দাঁড়াতে হলো। দেখতে দেখতে আমাদের ঘিরে একটা ভিড় জমে গেলে এবং সেখানে সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে দিলাম।

তবে মোড়ক উন্মোচন নিয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। একজন অনেক আগে থেকে আমাকে বলে রেখেছিলেন তার লেখা বইটির মোড়ক উন্মোচন করে দিতে হবে, আমি রাজি হয়েছিলাম। লেখক একজন পুলিশ অফিসার। ঠিক তখন তার একটা ডিউটি পড়ে গেলে তিনি আর মোড়ক উন্মোচনের জন্য তার বই নিয়ে আসতে পারলেন না। আমি পরদিন সিলেট চলে এসেছি। সকালে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি। হঠাৎ করে দেখি লেখক তার বই নিয়ে আমার অফিসে চলে এসেছেন। তিনি বলেছিলেন আমাকে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করবেন। তিনি সেটা থেকে পিছিয়ে যেতে রাজি না। আমার অফিসে আমি ছাড়া কেউ নেই, সেভাবেই আমার বইটির মোড়ক উন্মোচন করে দিতে হলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার বইটি নিয়ে সেই মুহূর্তে ঢাকা রওয়ানা দিলেন। (কয়েকবছর পর এই বইটি যখন কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল তখন আমার আনন্দের সীমা ছিল না!)

৪.
বইমেলার সবকিছুই কী ভালো? এখানে কী খারাপ কিছু নেই? আছে-এই বইমেলায় ভয়ংকর খারাপ কিছু আছে সেটা হচ্ছে বাথরুম! মানুষ যখন বইমেলা নিয়ে কথা বলে তখন ধরেই নেয় সাহিত্য, শিল্প, সৃজনশীলতা, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বড় জোর বইয়ের বাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে হবে। এর বাইরে কিছু বলা যাবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে বেঁচে থাকতে হলে তাকে নির্দিষ্ট সময় পরপর বাথরুমে যেতে হয়। তাই যেখানেই মানুষের ভিড় হয় সেখানেই বাথরুমের ব্যবস্থা করতে হয়। যে জাতি যত সভ্য তাদের বাথরুমের সংখ্যা তত বেশি এবং তাদের বাথরুম তত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। (এটি আমার কথা নয়, কোনো একজন বিখ্যাত মানুষ বলেছেন একটা জাতি কতোটুকু সভ্য সেটা বোঝার উপায় হচ্ছে তাদের বাথরুমের দিকে এক নজর তাকানো। ) এই বিখ্যাত মানুষের কথা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা এখনো অসভ্য ও বর্বর জাতি।

বাংলা একাডেমির বইমেলার বাথরুমের মতো কুৎসিত, জঘন্য, অপরিষ্কার, অস্বাস্থ্যকর জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই! এত বড় বইমেলা, এখানে হাজার হাজার মানুষ আসেন আর তাদের ব্যবহার করার মতো কোনো বাথরুম থাকবে না এটা কী করে সম্ভব?
বাথরুম সম্পর্কে কথা বলতে হলে আমার একটি ঘটনার কথা বলতে হবে- তবে সেটি মানুষের বাথরুম নয়, পাখির বাথরুম। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে কাক জাতীয় পাখিরা আমার মাথায় বাথরুম করতে খুব পছন্দ করে। এবাবের বই মেলায় আমি নজরুল মঞ্চে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করছি তখন একটি বইপ্রেমিক কাক আমার মাথায় বাথরুম করে দিল! আমার কিছু করার নেই। সেই অবস্থাতেই আমার পরের কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে হলো।

৫.
আমি নিশ্চিত বইমেলায় সবারই নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। আমাদের মতো মানুষ যারা লেখালেখি করে একটু পরিচিতি পেয়েছি তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন হতেই পারে! এবারের মেলায় আমার কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়।

বইমেলার ভেতরে ঢুকিনি, হঠাৎ করে অনেক ছেলেমেয়ে আমাকে ঘিরে ধরলো। আগে সেটা অটোগ্রাফের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তার সাথে ফটোগ্রাফ যোগ হয়েছে। আমি যখন ছবি তোলার জন্য ‘পোজ’ দিয়ে যাচ্ছি তখন হঠাৎ লক্ষ্য করলাম প্রায় দশ বারোজন ছোট ছোট মেয়ে আমার কাছে আসার চেষ্টা করছে। মেয়েগুলো ছোট হলেও বোরকা ও হিজাব দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা, শুধু চোখগুলো দৃশ্যমান। তাদের সাথে একজন বয়স্ক মানুষ। তিনি বেশ

বিচলিতভাবে আমাকে ঘিরে মানুষের জটলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অটোগ্রাফ দেওয়া নামক এই বিচিত্র প্রক্রিয়াটি বুঝতেও তার একটু সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারলেন তখন তিনি নিজেই আমার কাছে পরিচয় দিলেন। তিনি মেয়েদের মাদ্রাসার শিক্ষক। ছাত্রীদের নিয়ে বইমেলায় এসেছিলেন। এখন ফিরে যাচ্ছেন। অন্যদের দেওয়ার আগে তার ছাত্রীদের বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। আমি আনন্দের সাথে বাচ্চাগুলোর বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে গেলাম। তখন বাচ্চাগুলো বায়না ধরল তারা আমার সাথে ছবি তুলবে। আমি তখন অন্যদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বোরকা ও হিজাব পরা ছোট ছোট মেয়েগুলোকে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে দিলাম। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের ক্যামেরা কোথায়? তখন তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকালো এবং আবিষ্কার করল তাদের কোনো ক্যামেরা নেই। তাদের মন খারাপ হয়েছিল কী না জানি না- আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল।

বইমেলায় গেলে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য আমাকে ঘিরে ছেলেমেয়ে এবং অনেক সময় তরুণ-তরুণীদের একটা ভিড় হয়ে যায়। সবাই যে অটোগ্রাফ নিতে আসে তা নয়, অনেকে মানিব্যাগ ও মোবাইল টেলিফোন নিতে আসে। প্রতিবারই এরকম ঘটনা ঘটে। যখন শুকনো মুখে একজন আমাকে জানালো আমার অটোগ্রাফ নিতে গিয়ে তার মানিব্যাগ কিংবা মোবাইল ফোন চুরি হয়ে গেছে তখন আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। (একবার হঠাৎ করে দেখি একজন অত্যন্ত সুদর্শন ভদ্রলোককে অন্যেরা ধরে কিল ঘুসি মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে, ভিড়ের মধ্যে পকেট মারতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে। পকেটমারদের চেহারা যে রুচিবান সাংস্কৃতিককর্মীদের মতো হয় সেটা আমি জানতাম না। মানুষকে ধরে কিল ঘুসি মারার দৃশ্যটি সুন্দর নয়, তবে দৃশ্যটি অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যায় যখন দেখতে পাই একটি মেয়ে একটি ছেলের গালে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় মেরেই শান্ত হচ্ছে না। পা থেকে স্যান্ডেল খুলে তার গালে মারছে। এরকম দৃশ্যের অর্থ একটি, এই ছেলেটির ভিড়ের মাঝে মেয়েটির শরীরে হাত দিয়েছে। (কিংবা তার থেকে একশ গুণ বেশি অশালীন কোনো কাজ করে বসেছে) মেয়েদের অনেকে সেগুলো সহ্য করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় তেজি কোনো মেয়ে এই বিকৃত মনের কোনো মানুষকে ধরে ফেলে এবং তার কপালে তখন দুঃখ নেমে আসে।

এই বইমেলায় আমি এরকম একজন তরুণীর প্রচণ্ড জুতোপেটা থেকে উদ্ধার করে একজন অত্যন্ত সুদর্শন তরুণকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। পুলিশ তাকে শেষ পর্যন্ত কী করেছিল জানি না। সবার ধারণা হতে পারে এভাবে একজন বিকৃত মনের মানুষকে হাতেনাতে ধরে সবার সামনে আচ্ছা মতো জুতোপেটা করার ফলে সেই তরুণীটির বুঝি এক ধরনের মানসিক শান্তি হয়–সেটি কিন্তু মোটেও সত্যি নয়। এই মেয়ে বা তরুণীগুলো মানসিকভাবে এত বিপর্যস্ত হয়ে যায়, জগৎ সংসারের ওপর এত ঘৃণার জন্ম হয় এবং এত বিচলিত হয়ে যায় যে সেটি বলার মতো নয়। বইমেলায় এরকম একটি মেয়েকে স্বাভাবিক করে তুলতে আমার আর আমার স্ত্রীর অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল।

কেউ যেন মনে না করে বইমেলায় বুঝি শুধু এরকম খারাপ খারাপ ঘটনাই ঘটে, এটা মোটেও সত্যি নয়। অনেক মজার ব্যাপার ঘটে। কয়েকদিন আগে আমি মাথা গুঁজে আমাকে ঘিরে থাকা ছেলেমেয়েদের অটোগ্রাফ দিয়ে যাচ্ছি। তখন একজন আমাকে জানালো একটা ছোট মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি তাড়াতাড়ি তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন? মেয়েটা কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল, আমি আপনার অটোগ্রাফ নিতে যাচ্ছিলাম, আমার আম্মু বলে তুই মেয়ে মানুষ নিতে পারবি না। আমি মেয়ে হয়েছি বলে কী অটোগ্রাফ নিতে পারবো না? আমার আম্মু কেন আমাকে মেয়ে মানুষ বলে গালি দেবে?

যে আম্মুর বিরুদ্ধে এত বিশাল নালিশ তিনি কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। বলাই বাহুল্য তিনি খুবই অপ্রস্তুত! আমি ছোট মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে বললাম, সে মেয়ে মানুষ বলে মোটেও দুর্বল নয়- তার আম্মু তাকে ভুল বুঝেছেন! মেয়ে বলে সে পারবে না এরকম কোনো কাজ পৃথিবীতে নেই!

সেই কত আগে থেকে আমি ছোট বাচ্চাদের জন্য বই লিখে যাচ্ছি, ছোট বাচ্চারা সেই কৃতজ্ঞতায় আমাকে যে গভীর ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছে তার কোনো তুলনা নেই।
বইমেলায় এলে মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় সারা পৃথিবীতে বুঝি আমার মতো সৌভাগ্যবান আর আমার মতো সুখী মানুষ একজনও নেই!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।