ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মোদির দেশের মুক্তমত

সফর যেন আমাদের না বদলায় | সরোজ দরবার

মুক্তবিশ্লেষণ/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫২ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৫
সফর যেন আমাদের না বদলায় | সরোজ দরবার

আগামী ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসছেন প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দু’দিনের এ সফর দুই বন্ধুদেশের মধ্যকার যোগাযোগ, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সফর নিয়ে কী ভাবছেন মোদির দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বাংলানিউজের বিশেষ আয়োজনে থাকছে তাদের মতামত।  

মনমোহন সিং পারেননি, পেরেছেন নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশ সফরে তিনি শেষমেশ সঙ্গী হিসেবে যেতে রাজি করিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ঠিক এই একটি কারণেই প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বাংলাদেশের মানুষের কাছে যতটা আগ্রহের, ততটাই পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছেও।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর যে সর্ষে ছাড়া ইলিশ রান্না হতো, তা ভালোই জানতেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। অতীতে ইউপিএ সরকার মমতার অটল সিদ্ধান্তে ঠেকে যে শিক্ষা নিয়েছিল, তা আগেভাগেই আয়ত্ত করে নিয়েছেন তিনি। সেবার অসম ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হলেও রাজি হননি মমতা। তিস্তার জলে কেয়াপাতার নৌকা সেবার সহজে ভাসেনি।

এবারও প্রথম থেকেই যে রাজি ছিলেন তা নয়। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলাচ্ছে। যে মোদি-মমতাকে রণংদেহি রূপে এই কদিন আগেও দেখেছে জনগণ, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক দেখে সে অতীত লজ্জারুণ বধূর মতো মুখে ঘোমটা টানবে। তবু রাজনীতি নাকি সম্ভাবনার খেলা, সুতরাং সেখানে সব কিছুই সম্ভব। প্রাদেশিক রাজনীতির ঘাস আর কেন্দ্রীয় রাজনীতির ঘোড়াতেও তাই দিব্যি দোস্তি হয়ে গিয়েছে, অবশ্যই কন্ডিশন অ্যাপ্লাই। কিন্তু শর্তরা সাধারণত সাধারণ অবধি সচরাচর পৌঁছায় না, পণ্ডিতরা তা অনুমান করার চেষ্টা করেন মাত্র। এ কলমচি সে বর্গে পড়ে না যেহেতু, সুতরাং অনুমান না করে বরং ঘটমান নিয়ে ভাবাই শ্রেয়। ঘটনা হলো, মোদী ও মমতা দু’জনে হাত ধরাধরি করেই নামছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্রিজে। ফলত, যে সম্ভাবনা জোর মাথাচাড়া দিয়েছে তা হলো, এতদিনে কি তিস্তার জলবণ্টন সমস্যা সমাধানের মুখ দেখবে?

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অধিবাসীরা (দুই ক্ষেত্রেই কোঁদল ভালোবাসা একাংশ ছাড়া) চান কূটনীতির গেরোয় আটকে থাকা সমস্যাগুলো চুকেবুকে যাক। এই একটি দেশ আর প্রদেশের অধিবাসীরা অনেকাংশেই যে একই আত্মা বহন করেন, সে নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু কিছু জট তবু মেটে না। কিছু জল থমকে দাঁড়িয়ে থাকে, গড়াতে গড়াতেও গড়ায় না। ফলত বন্ধুতার প্রতিবেশেও এক হালকা অভিমানের মেঘ গাভীর মতো চরে বেড়ায়। তার খুঁটি আটকানো ওই নীতির সঙ্গে। সাধারণ মানুষ নীতির থেকেও বেশি করে জানেন নেতাদের। এদেশের মানুষ বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে মোদিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। একইরকমভাবে এ রাজ্যের মানুষও আশার বান ডাকিয়ে এনেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এক সরকারের পেরিয়েছে একবছর, অন্যটির চার। রিপোর্ট কার্ডে সবই যে লেটার মার্কস আর মেডেলপ্রাপ্তি, এমনটা মোটেও নয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও এই দু’জন নেতার ডায়নামিজমে বিশ্বাস করেন। রাজনীতির কাঁটা যে এদের এক ঘরে মিলিয়ে দিয়েছে, এতে পশ্চিমবঙ্গবাসীই বোধহয় সবথেকে খুশি হয়েছে। কেননা ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা তত্ত্ব’র মুখ একবার দেখেছে যে, আর সে ভিন্ননামে সমতত্ত্বের মুখ দেখতে চায় না। ফলত এবারের বাংলাদেশ সফর, মুখ্যমন্ত্রীর একক সফরের থেকেও আলাদা মাত্রা বহন করছে। মমতা একা গিয়ে সৌহার্দ্যের সুবাতাস বইয়েছেন বটে, কিন্তু তাতে কোনোরকম জট কাটেনি।

এবার অন্তত স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর প্রায় নিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে বেশ কিছুদিন থেকেই সচেষ্ট। পার্লামেন্টে এই বিল সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সংশোধন ইত্যাদিও পাশ করিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রয়োজনীয় পুর্নবাসন প্যাকেজের নিশ্চয়তা দেওয়ার পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত করেননি। চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে জমি হস্তান্তরের যে প্রক্রিয়া চলবে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা কী, তা আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস রাখেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজে যখন উপস্থিত থাকছেন, তখন কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, তিনি ঠিক বুঝে নেবেন। রাজনীতিক হিসেবে মমতার সে গ্রহণযোগ্যতা এখনও রাজ্যের মানুষের কাছে অটুট। গত চার বছরের সরকারে নানা কাজকর্মে সাধারণের ক্ষোভ থাকলেও, রাজনীতিক মমতার এই ইউএসপি এখনও প্রায় ম্যাজিক্যাল। প্রধানমন্ত্রী নিজে তা ভালো জানেন। তাই গোড়া থেকেই মুখ্যমন্ত্রীকে সফরে সামিল করার প্রয়াসী ছিলেন তিনি।

বাকি থাকল তিস্তার জল। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি একতরফা সিদ্ধান্ত কিছু নেবেন না। আলোচনার মাধ্যমে যা সমাধান সূত্র উঠে আসবে তাইই। জলে নারাজ নন মুখ্যমন্ত্রীও, কিন্তু উত্তরবঙ্গের স্বার্থ মাথায় রাখছেন তিনি। সুতরাং এ বিষয়ে কী হতে চলেছে তা ওই সম্ভাবনার খেলাই জানে। তবে জলে না হলেও স্থলে এবার ভালো কিছু হবে এমনটাই আশা করার। কারণ, পরিবহনের দিকটিও রয়েছে।

তবে শেষমেশ আমরা দুইদেশের সাধারণ নাগরিকরা আশা করে থাকব এক সুস্থতার বাতাবরণ, বিশেষত বাঙালিরা। কাঁটাতারের বিধান যখন আলাদা করেই দিয়েছে, তখন তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই এবং সে কারণে যা যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভোগ করতে হয়, তাও হবে। কিন্তু এই অছিলায় যেন আমাদের সহিষ্ণুতাকে আমরা নির্বাসনে না পাঠাই। সামান্য ক্রিকেট ম্যাচ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় বাদানুবাদের জেরে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে যেন বিদ্বেষে বিপন্ন না করে তুলি। রাজনীতির পট বদলালে হয়ত পরেরবার অন্য কোনো নেতা-মন্ত্রী সাক্ষী থাকবেন এই সফরের। কিন্তু সেদিনও বাংলা কবিতা লেখা হবে, যার আহ্বান তোলা থাকবে শুধু আমাদের জন্যই। সুসম্পর্কে যদি ভাবাবেগের জোর থেকেও থাকে, সুস্থ সম্পর্ক যুক্তির নিক্তি মোটামুটি মেনেই চলে। আমাদের গতায়াত হোক সেই পরিসরে। সফর আসে, সফর যায়... কিন্তু সম্পর্ক যেন না বদলায়, প্রার্থনা এটুকুই।

সরোজ দরবার
সাংবাদিক, কলকাতা 24x7

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৫
এসএস/

** মোদি-মমতার যৌথ সফর | অরুণ চক্রবর্তী
** মোদির বাংলাদেশ সফরে ভারতীয় হিসেবে আশা ‍| অভীক দত্ত
** মোদির বাংলাদেশ সফর: কিছু ভাবনা | পরিচয় পাত্র
** অনেক কিছুই পাওয়ার আশা ‍| ড. অমিতাভ চক্রবর্তী

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।