ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কিছু অনুপ্রেরণার গল্প

প্রসূন ঘোষ রায়, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬
কিছু অনুপ্রেরণার গল্প হুমায়ূন আহমেদ, ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট, স্টিফেন হকিং ও সুধা চন্দ্রন

হুমায়ূন আহমেদ স্যার যখন আমেরিকায় পিএইচডি করতে এলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রথম ক্লাসেই বেশ অবাক হয়ে গেছিলেন এক সহপাঠীকে দেখে। কারণ সেই সহপাঠী ছিলেন অন্ধ।



স্যারের ধারণা ছিল, অন্ধ ছেলেমেয়েরা হয়তো শুধু অব্যবহারিক বিষয়গুলোই পড়েন। রসায়নের মতন ব্যবহারিক এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতন কঠিন কাটখোট্টা বিষয় যে একজন অন্ধ ছেলে পড়ার টপিক হিসেবে বেছে নিতে পারে এটা তার ধারণাতেই ছিলো না।

তার এসব ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্যার নিজেই জীবনে প্রথম বারের মতন কোয়ান্টাম মেকানিক্সে মারলেন ফেল। যে সে ফেইল না, পরীক্ষায় একেবারে শূন্য পেয়ে ফেল করলেন হুমায়ূন আহমেদ স্যার। আর জানেন কে পেয়েছিল সর্বোচ্চ নাম্বার? সেই জন্মান্ধ সহপাঠী! যেটা দেখে স্যার নিজেই অবাক হয়েছিলেন।

পরবর্তী সেমিস্টারে প্রফেসর যখন কোয়ান্টাম মেকানিক্স না নিতে বলেন, তখন সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সেই অন্ধ ছেলেটি। স্যারের য‍ুক্তি ছিলো, সে যদি শুধু কান দিয়ে শুনেই সর্বোচ্চ নাম্বার পেতে পারে- তাহলে আমি কেন কান দিয়ে শুনে, চোখ দিয়ে দেখে পাশ করতে পারব না? তাই পরবর্তী সেশনে স্যার আবার নিয়েছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং পরীক্ষায় পেয়েছিল ১০০% নাম্বার।

ভারতের সুধা চন্দ্রন, একজন নৃত্যশিল্পী। ১৬ বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে তামিলনাড়ুতে দুর্ঘটনায় পড়লেন, ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেবেন এমন সময় দেখলেন তার ডানপায়ে গ্যাংগ্রিন বাসা বেঁধেছে। বেঁচে থাকতে হলে ডান পা কেটে বাদ দিতে হবে। একজন নৃত্যশিল্পীর জন্য পা-ই সব। তাই কোন নৃত্যশিল্পীর পা কেটে বাদ দেওয়া এবং নাচের দুনিয়াকে বিদায় জানানো প্রায় সমান কথা।

কিন্তু সুধা চন্দ্রন থেমে থাকার পাত্রী না। পা কেটে বাদ দেওয়ার পর আর্টিফিশিয়াল পা লাগিয়ে চালিয়ে গেলেন তার প্রিয় ভারতনাট্যম নাচের প্র্যাকটিস, হয়ে গেলেন ভারত বর্ষের ইতিহাসে অন্যতম বড় ড্যান্সার। শুধু তাই নয়। এই ড্যান্সার পরিচয়টাকে পুঁজি করে তিনিই পরবর্তীতে হয়েছিলেন ভারতের অনেক নামি টিভি সিরিয়ালের নায়িকা।

এবার বলি ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্টের কথা। আমেরিকার ৩২তম প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দেশটির আর সব প্রেসিডেন্ট এর চেয়ে অনেকখানিই আলাদা। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বলেই নয়, আমেরিকার ইতিহাসে চারবার প্রেসিডেন্ট হওয়া একমাত্র ব্যক্তিও এই রুজভেল্ট। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পৃথিবী যখন অর্থনৈতিক মন্দা ও যুদ্ধের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত, সে সময় তিনি পৃথিবীর কেন্দ্রীয় এক চরিত্রে পরিণত হন।

১৯১০ সালে বেশ সাড়ম্বরে রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও প্রেসিডেন্ট হওয়ার ১২ বছর আগে ১৯২১ সালে পোলিও রোগ ধরা পড়ে তার শরীরে। পোলিও ভাইরাসের প্রভাব এতই বেশি হয়ে যায় যে, খুব অল্প সময়েই তার হাঁটাচলার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। কোমরের নিচের অধিকাংশ অঙ্গ অবশ হয়ে যায় তার। কিন্তু দমেননি তিনি। সাধারণত হুইল চেয়ারে চলাফেরা করলেও কোমরে আর পায়ে আয়রন ব্রেসলেট লাগিয়ে শর্ট ডিস্টেন্সের রাস্তাগুলো তিনি পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিতেন।

পোলিও রোগ ধরা পড়ার ১২ বছর পর যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন থেকে তাকে কেউ হুইল চেয়ারে চড়তে দেখেননি। যদিও লোকচক্ষুর অন্তরালে সবসময়ই হুইল চেয়ার ব্যবহার করতেন তিনি। কারণ তার ধারণা ছিল, হুইল চেয়ারে চড়া একজন প্রেসিডেন্টকে কম পরাক্রমশালী মনে হতে পারে প্রতিপক্ষের কাছে। চরম পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট এই রুজভেল্ট দীর্ঘ ১২ বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ১৯৪৫ সালে মৃত্যু বরণ করলেও এখনো অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

এবার যার কথা বলব তাকে আমরা সবাই চিনি। একুশ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে যখন তার Amyotrophic Lateral Sclerosis (ALS) বা Motor Neurone Disease রোগ ধরা পড়ে তখন ডাক্তার বলেন, এই রোগী আর মাত্র ২ বছর বাঁচবে। অথচ এখন তার বয়স ৭৩। সেই একুশ বছর বয়স থেকে হুইল চেয়ারে বসে হাত-পা থেকে শুরু করে সারা শরীরের অক্ষমতা আর অবশতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যে মানুষটি সবাইকে পথ দেখিয়ে চলেছেন এবং তার মতো ডিসেবল মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছেন তিনি বর্তমান বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।

এ ছাড়াও আরো শতশত উদাহরণ দেওয়া যাবে যারা শারীরিক, মানসিক অক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে তীব্র ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে সারাবিশ্বের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। অথচ সব কিছু পেয়েও আমরা না পাওয়ার হিসেবটাকে লম্বা করি প্রতিনিয়ত। লম্বা করতে করতে একসময় সেই লম্বা লিস্ট দেখে নিজেরাই ভয় পেয়ে মুষড়ে পড়ি। পালিয়ে যাই কিংবা ছেড়ে দিই জীবনের চ্যালেঞ্জ। তাই ছেড়ে দেওয়ার আগে এসব মানুষের কথা আর একটু ভাবুন। যারা হাজারো সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে পেরেছিলেন নিজেদের চেষ্টায়, হয়তো আপনিও পারবেন। তাই দেখুননা একটু চেষ্টা করে, এবার হয়তো আপনারই পালা।

প্রসূন ঘোষ রায়: মাস্টার্স স্টুডেন্ট (রসায়ন), সেন্ট জোন্স ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্ক

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।